১৯৪৭ সালে জম্মু গণহত্যা – জম্মু ফাইল

Jammu killing banner

জম্মুতে মুসলমানরা কিভাবে সংখ্য়ালঘু হলো।

“কাশ্মির ফাইল”এর পর “বারামুল্লা” । কাশ্মীরের অশান্তিকে সামনে রেখে ভারতীয় মুসলমানদেরকে একটা সন্ত্রাসবাদী সম্প্রদায় হিসাবে দেখানোর প্রচেষ্টা, বলিউডি-হিন্দুস্থানি প্রপাগাণ্ডা চলছেই। প্রশ্ন হচ্ছে, ১৯৯০ সালে পণ্ডিতদের সাথে কী ঘটেছিল, তার জন্য যদি একটার পর একটা সিনেমা তৈরি করা হয়, তাহলে ১৯৪৭ সালে জম্মুতে মুসলমানদের সাথে কী ঘটেছিল তার জন্য কেন একটাও সিনেমা তৈরি করা হয় না? যদি আমরা ১৯৯০ সালে পণ্ডিতদের সাথে কী ঘটেছিল তা মনে রাখতে চাই, তাহলে ১৯৪৭ সালে জম্মুতে মুসলমানদের সাথে কী ঘটেছিল তা মনে না রাখাটা অপরাধ।

১৯৯০ সালে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের সাথে ঘটে যাওয়া দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাকে “জাতিগত নির্মূল” এবং “গণহত্যা” হিসাবে বর্ণনা করা হচ্ছে। সত্য হলো, স্বাধীনতার আগে জম্মুতে মুসলিমরাই ছিল সংখ্যা গরিষ্ঠ। ১৯৪৭ সালে, জম্মু প্রদেশে মুসলিমরা ছিল ৬১ শতাংশ। ১৯৪১ থেকে ১৯৬১ সালের মধ্যে, জম্মুর মুসলিম জনসংখ্যা ৬১ শতাংশ থেকে কমে ৩৮ শতাংশে নেমে আসে। ২ লক্ষের বেশি মুসলমানকে খুন করে, প্রায় ৫ লক্ষ মুসলমানকে ঘর ছাড়া, দেশ ছাড়া করে, জম্মুতে মুসলমানদের সংখ্যালঘু বানানো হয়। এর প্রতিক্রিয়াতেই পরবর্তিকালে কাশ্মিরে সাম্প্রদায়িক অশান্তি শুরু হয়। কয়েকজন পণ্ডিত খুন হয়, এবং বাকিরা ভয়ে উপত্যাকা থেকে পালিয়ে যায়।

১৯৪৭ সালে জম্মুতে ঘটে যাওয়া মুসলমানদের গণহত্যা, মুসলমান নারীদের উপর পাশবিক অত্যাচারের ঘটনা, কাশ্মীরি হিন্দু পণ্ডিতরা সম্যকভাবে অবহিত ছিল এবং তারা এর প্রতিশোধমূলক প্রতিক্রিয়ার আশংকায় দিন কাটাচ্ছিল। ১৯৯০ সালে অশান্তি শুরু হলে কাশ্মীরি পণ্ডিতরা ভয় পেয়ে যায় এবং দেশান্তরিত হতে থাকে। ২০১০ সালের মার্চ মাসে, রাজ্য সরকার আইনসভাকে জানিয়েছিল যে ১৯৯০ সালে কাশ্মীরি পণ্ডিদের সংখ্যা ছিল মোট ১৫০,০০০ জন, বেসরকারি মতে ২,০০০,০০০ জন। এদের মধ্যে ১৯৯০ সালের জানুয়ারিতে ২৪,২০২টি পরিবার দেশান্তরিত হয়েছিল। প্রতি পরিবারে পাঁচজন করে ধরলে, ১২১,০১০ জন। এবং ১৯৮৯ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে, ১৫ বছরে নিহত পণ্ডিতের সংখ্যা ছিল ২১৯ জন। সরকারি হিসাব অনুযায়ী ১৯৯০ সালের অভিবাসনের পর ৩০,০০০ জন পণ্ডিত উপত্যাকাতে ছিলেন, বেসরকারি মতে ২০,০০০ জন। পরবর্তীতে ২০১৫ সালের দিকে এই সংখ্যাটা কমে প্রায় ৩,৫০০ জনে নেমে আসে।

জম্মুর হত্যাকাণ্ডে নিহতের সংখ্যা কত ছিল?

যেহেতু কোন সরকারী পরিসংখ্যান নেই, তাই সেই সময়ের কিছু ভারতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদই আমাদের ভরসা। ব্রিটিশ সংবাদপত্র “দ্য স্পেক্টেটর”এ 16 জানুয়ারী 1948 সালে রিপোর্ট করা হয়েছিল যে; নিহতের সংখ্যা 200,000 জন। “হর্নড মুন”এ, ১৯৫৩ সালের এক রিপোর্ট লেখা হয়েছিল যে “১৯৪৭ সালের শরৎকালে, প্রায় পুরো মুসলিম জনসংখ্যা, যার পরিমাণ কয়েক লক্ষ ছিল, হত্যা করা হয়েছিল বা পালিয়ে গিয়েছিল। “দ্য টাইমস”, লন্ডনে প্রকাশিত 10 আগস্ট 1948 সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল – “2,37,000 মুসলমানকে পরিকল্পিতভাবে নির্মূল করা হয়েছে …” । এটি ঘটেছিল 1947 সালের অক্টোবরে, পাঠান আক্রমণের পাঁচ দিন আগে এবং মহারাজার ভারতে যোগদানের নয় দিন আগে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, গণহত্যা/অভিবাসনের ফলে, জম্মু অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ (৬১ শতাংশ) মুসলমানরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। “দ্য স্টেটসম্যান” -এর সম্পাদক ইয়ান স্টিফেন্স বলেন যে, ৫০০,০০০ মুসলমানকে জম্মু থেকে পুরোপুরি উচ্ছেদ করা হয়।

মহাত্মা গান্ধী 25 ডিসেম্বর 1947-এ জম্মুর পরিস্থিতি সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন: “জম্মুর হিন্দু ও শিখ এবং যারা বাইরে থেকে সেখানে গিয়েছিল (গুরুদাসপুর এবং আশেপাশের অঞ্চল থেকে আরএসএস ক্যাডার) তারা সেখানে মুসলমানদের হত্যা করেছিল। তাদের মহিলাদের অসম্মান করা হয়েছে। সংবাদপত্রে এটি পুরোপুরি প্রকাশিত হয়নি। সেখানে যা ঘটেছে তার জন্য কাশ্মীরের মহারাজা দায়ী।” (মহাত্মা গান্ধীর সংগৃহীত রচনা, খণ্ড ৯০, পৃষ্ঠা ১১৫ এবং ২৯৮)।

পটভূমি

ভারত বিভাজনের সময়, ব্রিটিশরা দেশীয় রাজ্যগুলোর ওপর তাদের আধিপত্য পরিত্যাগ করে এবং রাজ্যগুলোকে ভারত বা পাকিস্তানে যোগদান অথবা স্বাধীন থাকার সুযোগ দেয়। জম্মু ও কাশ্মীরের সংখ্যা গরিষ্ঠ জনগন মুসলমান হলেও রাজা ছিলেন হিন্দু। মহারাজা হরি সিং মুসলমান প্রধান পাকিস্তানে যোগদান করতে চাইলেন না, কিন্তু তিনি গনতান্ত্রিক ভারতেও যোগদান করলেন না। তিনি একজন স্বাধীন স্বৈরাচারী রাজা হয়েই থাকতে চাইলেন।

মহারাজা হরি সিং আশঙ্কা করেছিলেন যে, কাশ্মীর মুসলিম অধ্যুষিত হওয়ায় ভবিষ্যতে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হতে পারেন এবং পুরো জম্মু-কাশ্মীর পাকিস্তানে যোগ দিতে পারে। সেজন্য তিনি পুরো জম্মু-কাশ্মীর না হলেও, অন্ততপক্ষে জম্মুতে যাতে নিজের শাসন কায়েম রাখতে পারেন, তার জন্য তিনি জম্মু থেকে সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলমান জনগনকে উচ্ছেদ করার ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করেন। অন্য প্রদেশের মানুষ কাশ্মীরে জমির দখল নিতে পারবেন না, এই আইন ১৯২৬ সালে মহারাজা হরি সিং নিজেই তৈরি করেছিলেন। কিন্তু ১৯৪৭ সালের পরে তারই উদ্যোগে পরিকল্পিতভাবে পাঞ্জাব এবং সীমান্তবর্তী প্রদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হিন্দু ও শিখ শরনার্থিরা জম্মুতে এসে বসবাস শুরু করে। সেই সঙ্গে মহারাজা হরি সিং জম্মুর শুধুমাত্র মুসলমান-প্রজাদের উপর নানাবিধ কর আরোপ করেন। করের এ হেন বোঝা চাপানো ও অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে স্থানীয় মুসলমানরা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন৷ হরি সিং সৈন্য নামিয়ে, বল প্রয়োগ করে নির্মমভাবে সে বিক্ষোভ দমন করেন।

এরপর ডোগরা সৈনবাহিনী নামিয়ে জম্মুর মুসলমান প্রধান গ্রামগুলি খালি করে দেওয়া হতে থাকে। রাজ্য বাহিনীর এক-তৃতীয়াংশ ও পুলিশের অর্ধেকের বেশি সদস্য তখন মুসলমান ছিলেন। উচ্ছেদ অভিযান শুরু করার আগে সেনা এবং পুলিশ বাহিনী থেকে মুসলমানদের অপসারণ করা হয়।

মার্চ ১৯৪৭-এ রাওয়ালপিন্ডিতে দাঙ্গার পর অনেক হিন্দু-শিখ জম্মুতে পালিয়ে আসে, সেই সঙ্গে তারা নিয়ে আসে বাস্তব-অবাস্তব, সত্য-মিথ্যা মিশ্রিত ঘটনার অতিরঞ্জিত বর্ননা। যা জম্মুর হিন্দু-শিখদের মনে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ স্পৃহা সৃষ্টি করে।

পুঞ্চে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৫০,০০০ প্রাক্তন সৈনিক ছিল, যাদের অনেকের কাছে তখনও বন্দুক ছিল। জুলাই মাসে সমস্ত অস্ত্রধারীদের থানায় অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু মুসলিম প্রাক্তন সৈন্যদের জমা দেওয়া অস্ত্র মহারাজার পুলিশ হিন্দু ও শিখ শরনার্থিদের হাতে হস্তান্তর করে।

অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে, হিন্দু-শিখ সন্ত্রাসবাদী এবং ডোগরা সেনাবাহিনী জম্মু প্রদেশ থেকে মুসলিম গ্রামবাসীদের বিতাড়িত করতে শুরু করে। গ্রামবাসীরা প্রাণবাঁচাতে পায়ে হেঁটে পশ্চিম পাঞ্জাবের দিকে পালিয়ে যায়, সেখানে বেশিরভাগলোক শিয়ালকোট, ঝিলাম, গুজরাট এবং রাওয়ালপিন্ডি জেলার শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় লাভ করে।

১৪ অক্টোবর, হিন্দু-শিখ সন্ত্রাসবাদীদের দল জম্মুর বিভিন্ন গ্রামে (আমরে, চেক, আত্মাপুর, কচপুরা) হামলা চালায়, মুসলমানদের হত্যা করে তাদের বাড়িঘরে আগুন লাগায়। রাজ্যের ডোগরা সেনাবাহিনী এই আক্রমণে নেতৃত্ব দেয় এবং দাঙ্গাকারীদের অস্ত্র দেয়। মুসলমান অধ্যুষিত এলাকা ছাড়া অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমানদের দাঙ্গাকারীরা গাড়ি নিয়ে ঘুরে ঘুরে হত্যা করে। দুধ সরবরাহকারী গুজ্জর মুসলিম নারী-পুরুষদের পথেই হত্যা করা হয়।

মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার বাইরে বসবাসকারী অনেক মুসলমানকে হিন্দু-শিখ সন্ত্রাসবাদীদের দ্বারা নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। সরকারীভাবে কারফিউ থাকা সত্ত্বেও হিন্দু-শিখ সন্ত্রাসবাদীরা অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে যানবাহনে অবাধে চলাচল করত। আসলে কারফিউ ছিল শুধুমাত্র মুসলমানদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রন করার জন্য।

তলব খটিকান ও মহল্লা উস্তাদের মুসলিমরা অবরুদ্ধ হন, তাদের খাবার ও পানি বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রশাসন তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার পরিবর্তে নিরাপত্তার জন্য পাকিস্তানে যেতে উৎসাহিত করে। কয়েক হাজার মুসলমানের প্রথম ব্যাচকে প্রায় ষাটটি লরিতে বোঝাই করে শিয়ালকোটে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের কী হতে চলেছে তা বুঝতে না পেরে এই পরিবারগুলি লরিতে উঠেছিল। যানবাহন সৈন্য দ্বারা এসকর্ট করা হয়. কিন্তু যখন তারা শহরের উপকণ্ঠে জম্মু-শিয়ালকোট সড়কে চাট্টার কাছে পৌঁছায়, যেখানে আগেথেকেই প্রচুর সশস্ত্র হিন্দু ও শিখ উদ্বাস্তু অবস্থান করেছিল, সেখানে মুসলমানদেরকে যানবাহন থেকে টেনে বের করে আনা হয় এবং নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়। মহিলাদেরকে ধর্ষণ ও অপহরণ করা হয়। ডোগরা সৈন্যরাও সন্ত্রাসবাদীদের সাথে যোগদান করে অথবা নিষ্ক্রিয় দর্শকের মতো তাকিয়ে থাকে। গণহত্যার খবরটি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে গোপন রাখা হয়েছিল। পরের দিন মুসলিম পরিবারের আরেকটি দলকে একইভাবে গাড়িতে চড়িয়ে নিয়ে গিয়ে একই পরিণতি করা হয়। যারা কোনোভাবে খুনিদের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে পেরেছিল তারা তাদের দুঃখের কাহিনী বর্ণনা করতে শিয়ালকোটে পৌঁছেছিল…

৫ নভেম্বর, ডোগরা সেনাবাহিনীর সৈন্যরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে আরেকটি সংগঠিত উচ্ছেদ শুরু করে। কিন্তু তাদের শিয়ালকোটে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে, ট্রাকগুলি জম্মুর রাজৌরি জেলার জঙ্গল পাহাড়ে নিয়ে যায়, যেখানে তাদেরও আগের লোকদের মত একই পরিনতি হয়।

ওই সময় জম্মুর উধমপুর, ছেনানি, রামনগর, রিয়াসি, বাদেরওয়া, ছাম্ব, দেবা বাটালা, আখনুর, কাটুয়াসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় আবালবৃদ্ধবনিতা বহু মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের তীব্রতা এতটাই ছিল যে প্রায় ১২৩টি গ্রাম ‘সম্পূর্ণ জনশূন্য’ হয়ে পড়েছিল। শুধুমাত্র জম্মু জেলায় মুসলিমদের সংখ্যা ১,০০,০০০ এরও বেশি হ্রাস পায়, আনুমানিক ২৭০০০ মুসলিম মহিলাকে অপহরণ ও ধর্ষণ করা হয়। স্থানীয় মহল্লাগুলিতে হাজার হাজার গুজ্জরকে গণহত্যা করা হয়েছিল এবং জম্মু সেনানিবাস এলাকার গ্রামগুলি সম্পূর্ণরূপে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। কুথুয়া তার মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ ‘হারিয়ে’ ফেলেছিল। ডোগরা রাজ্যের সৈন্যরা মুসলমানদের উপর আক্রমণের অগ্রভাগে ছিল। যারা বাড়িঘর ছেড়ে প্রাণবাঁচাতে পাকিস্তান সীমান্তের দিকে রওয়া হয়েছিল, তাদেরও অনেককেই ধরে ধরে হত্যা করা হয়। গণহত্যা চলাকালীন কার্ফু জারি করা হয়েছিল, তবে সেগুলি ছিল মূলত মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলির জন্য, মুসলিমদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করতে। অন্যদিকে হত্যাকারীরা বাধাহীনভাবে খোলা অস্ত্র হাতে নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছে এবং হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে গেছে।

মুসলিমদের হত্যার পর স্থানগুলির নামও অবিলম্বে পাল্টে ফেলা হয়েছিল। উর্দু বাজার রাজিন্দর বাজার এবং ইসলামিয়া স্কুল হরি সিং উচ্চ বিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছিল। মুসলমানদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি যা স্বাভাবিকভাবে রাজ্য সরকারের দখলে নেওয়ার কথা ছিল, সেগুলো সব লুটেরা এবং দাঙ্গাবাজদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। এই সম্পত্তিগুলি এখনও লুটেরা এবং তাদের বংশধরদের অবৈধ দখলে রয়েছে।

“দ্য টাইমস”, লন্ডনে প্রকাশিত 10 আগস্ট 1948 সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আনুমানিক প্রায় ৮ লক্ষ মুসলিম যারা প্রাণ বাঁচাতে দেশান্তরিত হওয়ার চেষ্টা করেছিল, তাদের মধ্যে “২,৩৭,০০০ এরও বেশিকে ডোগরা রাজ্যের সৈন্য বাহিনী দ্বারা পরিকল্পিতভাবে নির্মূল করা হয়েছিল, যাদের নেতৃত্বে ছিলেন মহারাজা হরি সিং এবং হিন্দু ও শিখ উদবাস্তুরা।” স্থানীয় মিডিয়াও হত্যাকাণ্ড এবং দেশত্যাগকে তীব্রতর করে তুলেছিল। উদাহরণস্বরূপ, জম্মু-ভিত্তিক একটি হিন্দু পত্রিকা গর্ব করে বলেছিল যে ‘একজন ডোগরা কমপক্ষে দুই শতাধিক মুসলিমকে হত্যা করতে পারে’।

১৯৬১ সালের ভারতের আদমশুমারির হিসাব অনুযায়ী, জম্মু প্রদেশে প্রায় ১২৩টি গ্রাম ‘সম্পূর্ণ জনশূন্য’ হয়ে পড়েছিল, যেখানে শুধুমাত্র জম্মু জেলায় মুসলিমদের সংখ্যা হ্রাস পায় ১,৫০,০০০-এরও বেশি।

এলাকা1941 জনসংখ্যা 1941 মুসলিম % 2011 মুসলিম % মুসলমানদের সংখ্যা হ্রাস
জম্মু জেলা431,36239.6%7.1%151,010
কাঠুয়া জেলা177,67225.3%10.4%29,567
উধামপুর জেলা
(চেনানি সহ:)
306,01342.7%41.5%5,975
রেয়াসি জেলা257,90368.1%58.4%59,804
জম্মু জেলা
(পুঞ্চ ও জম্মু জেলা)
1,172,95044.5%27.9%246,356
পুঞ্চ জায়গীর421,82890.0%90.4%

কাশ্মীর ভাগ হলো

জম্মুর অনেক মুসলমান পরিবারের সঙ্গে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের (এখন খাইবার পাখতুনখোয়া) উপজাতীয় লোকেদের পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। জম্মু হত্যাকাণ্ডের পাঁচ দিন পর, পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে উপজাতীয় মিলিশিয়ারা নিজেদের আত্মীয়-স্বজনদের জীবন ও সম্মান রক্ষার্থে ভারতে প্রবেশ করে এবং কাশ্মীরে আক্রমণ করে। যখন উপজাতীয়দের সেনাবাহিনী কাশ্মীরে ছুটে আসে, তখন ডোগরা রাজার সেনাবাহিনী, যারা এতোদিন ধরে নিরিহ নিরস্ত্র মুসলমানদের গণহত্যায় লিপ্ত ছিল, জম্মুতে পালিয়ে যায়। রাজা হরি সিং শেষ পর্যন্ত নিজের প্রাণ বাঁচাতে ভারতের সাথে যোগদানের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ভারত তখন উপজাতীয়দের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তার সেনাবাহিনী পাঠায়।

উপজাতীয়দের এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে কয়েক সপ্তাহের লড়াই অবশেষে প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের দিকে পরিচালিত হয়। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে যখন নয়াদিল্লি এবং ইসলামাবাদ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়, তখন জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন রাজত্ব দুই দেশের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়।

উপসংহার

১৯৯০ সালে পণ্ডিতদের সাথে যা ঘটেছিল তা লঘু করা এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য নয়। নিঃসন্দেহে এটি একটি অগ্রহণযোগ্য এবং অমার্জনীয় অপরাধ ছিল। এই প্রতিবেদনের লক্ষ্য হলো ১৯৪৭ সালে জম্মুতে দু-মাস ধরে চলা মুসলমানদের গণহত্যার ভুলে যাওয়া গল্পটি ভারতবাসীকে মনে করিয়ে দেওয়া। যদি এটা ঠিক হয় যে, কাশ্মীরি পণ্ডিতদের প্রতি আচরণ আমাদের কখনই ভুলে যাওয়া বা ক্ষমা করা উচিত নয়, তাহলে জম্মুর মুসলমানদের প্রতি যা করা হয়েছিল, তা মনে না রাখার এবং ক্রমাগত নিন্দা না করার কোনও অজুহাত ভারতবাসীর নেই। এটি শুধুমাত্র বৌদ্ধিক সততার বিষয় নয়, এটি ভারত গঠনকারী বহুজাতিক জনগণের ঐক্যের উপর প্রভাব ফেলে। আমাদের স্মৃতি বা ইতিহাস চর্চা যদি নির্বাচনী হয়ে ওঠে, তবে এটি একতরফাও হয়ে যায় এবং এটি আমাদের বহুজাতিক ভারতের ঐক্যকে বিভক্ত করতে পারে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে, জম্মু গণহত্যা ভয়াবহ জাতিগত নির্মূল পর্বগুলির মধ্যে একটি। ঐতিহাসিক এবং গবেষকদের মতে কাশ্মীরে চিরস্থায়ী সংঘাতের মূলে রয়েছে এই ইচ্ছাকৃতভাবে ভুলে যাওয়া ১৯৪৭ সালের গণহত্যা।

আজকের প্রজন্ম, যাদের নিকটআত্মীয়রা সেদিন গণহত্যা এবং ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন এবং যারা ভাগ্যক্রমে তাদের ঘরবাড়ি, সহায় সম্বল ফেলে রেখে পালিয়ে জীবন বাঁচাতে পেরেছিলেন, তারা আজ বার বার সন্ত্রাসবাদী হয়ে ফিরে আসছে কিনা সেটা একটা ভাববার বিষয়।

আজ যখন CAA-র মাধ্যমে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্থানে ধর্মীয় উৎপিড়নের শিকার সংখ্যালঘুদের ভারতে আশ্রয় দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তখন ভারতের বুকে ধর্মীয় সহিংসতার শিকার হয়ে যে মুসলমানরা প্রাণ বাঁচাতে বাধ্য হয়ে ঐ দেশগুলোতে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল, তারা যদি আজ তাদের স্বভূমিতে ফিরে আসতে চায়, সে সুযোগ তাদের দেওয়া হবেনা কেন, সেই প্রশ্নও উঠছে।