স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন – “জগন্নাথ-মন্দির একটি প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির। আমরা ঐটিকে এবং অন্য়ান্য বৌদ্ধ মন্দিরকে হিন্দু মন্দির করিয়া লইয়াছি।” তবুও আজকের দিনে পুরির জগন্নাথ-মন্দিরকে পুনরায় বৌদ্ধ মন্দিরে রূপান্তরিত করার কথা কেউ বলেনা। এই ধরনের কাজ আজকের দিনে আমরা কেউই সমর্থন করব না। কিন্তু প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি (সিজেআই) ডি.ওয়াই. চন্দ্রচূড় বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে রাম মন্দির তৈরি করাকে সমর্থন করে বসলেন।
২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের অযোধ্যা রায়ের বিপরীতে, ভারতের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি (সিজেআই) ডি.ওয়াই. চন্দ্রচূড় নিউজলন্ড্রিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই বলে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন যে, “ষোড়শ শতাব্দীতে বাবরি মসজিদ নির্মাণই ছিল মৌলিকভাবে অপবিত্র করার কাজ।”
বিচারপতি (অবসরপ্রাপ্ত) চন্দ্রচূড় তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চের সদস্য ছিলেন, যারা ২০১৯ সালের নভেম্বরে অযোধ্যার বিতর্কিত স্থানে রাম মন্দির নির্মাণের জন্য সবুজ সংকেত দিয়েছিলেন।
যদিও রায়ে, বেঞ্চ জোর দিয়ে বলেছে যে ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ (এএসআই) তার প্রতিবেদনে বলেছে যে মসজিদের নীচে বহুস্তর বিশিষ্ট নির্মাণ-বির্নির্মাণ-পুনর্নির্মাণ কার্যের প্রমান পাওয়া গেছে, যেগুলো কয়েক শতাব্দী ধরে চলেছিল। তবে এমন কোনও প্রমাণ ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপের কাছে নেই যে বাবরি মসজিদ নির্মাণের জন্য কোনো কিছু ভেঙে ফেলা হয়েছিল।
তবুও ২৪শে সেপ্টেম্বর প্রকাশিত নিউজলন্ড্রির শ্রীনিবাসন জৈনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে চন্দ্রচূড় বলেন যে মন্দির ভেঙে বাবরি মসজিদ তৈরি হয়েছিল এবং এটা একটা “মৌলিকভাবে অপবিত্র” কাছ ছিল।
বিচারপতি (অবসরপ্রাপ্ত) চন্দ্রচূড় তার বক্তব্যে মূলত দুটি কথা বলেছেন, (এক) তিনি মনে করেন হিন্দু মন্দির ভেঙেই বাবরি মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল। (দুই) কোন ধর্মস্থান (এক্ষেত্রে হিন্দু মন্দির) ভেঙে সেখানে অন্য কোন ধর্মিয় স্থাপনা তৈরি করা (এক্ষেত্রে মসজিদ) অনৈতিক – অন্যায় বা অপবিত্র কাজ।
এএসআই প্রতিবেদন (ASI Report)
ASI প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে প্রাথমিক স্তরের (প্রথম থেকে তৃতীয় পর্যায়) কাঠকয়লার নমুনার C14 নির্ণয়ের পরীক্ষার ফলাফল থেকে জানা যায়, ঐ এলাকায় মানুষের কার্যকলাপ খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শেষ শতাব্দী থেকে শুরু হয়েছিল।
ASI রিপোর্টে মোট নয়টি যুগের কথা বলা হয়েছে —
(i) পর্ব – I : উত্তর ভারতীয় শহুরে সংস্কৃতি – মৌর্য যুগ
এই পর্যায়টি খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ থেকে তৃতীয় শতাব্দীর মধ্যে পড়ে। এই সময়েই প্রথম মানুষ ওই স্থানে বসবাস শুরু করে।
এই স্তরে কোনো উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যিক কর্মকাণ্ড দেখা যায়নি, তবে পোড়া মাটিতে খড়ের ছাপ (reed impressions) পাওয়া গেছে, যা প্রাচীন নির্মাণের ইঙ্গিত দেয়।
খননে যে সমস্ত বস্তু পাওয়া গেছে সেগুলো হলো —
ভাঙা ওজন মাপার পাথর, পবিত্র জলাধারের টুকরো, কানের দুল, চাকতির মতো খেলা, চাকাযুক্ত ডিস্ক, টেরাকোটা প্রাণীর ভাঙা মূর্তি, ভাঙা লোহার ছুরি, কাঁচের পুঁতি, হাড়ের সূচ ইত্যাদি। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হলো —
সবুজাভ কাঁচের তৈরি একটি বৃত্তাকার বেজেল (bezel), যার এক পাশে অশোকীয় ব্রাহ্মী লিপিতে উচ্চ খোদাই করা “সিদ্ধে” শব্দটি উৎকীর্ণ আছে এবং অপর পাশটি মসৃণ।

(মৌর্য সম্রাট অশোক এবং অশোকের বংশধরেরা বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সম্রাট অশোক দেশে বিদেশে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেছিলেন। অনুমান করাযায় এই সময়ে এখানে একটা বৌদ্ধ মঠ নির্মাণ করা হয়েছিল।)
(ii) পর্ব – II : শুঙ্গ যুগ
এই স্তরটি আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় থেকে প্রথম শতাব্দী-এর।
এই সময়ে প্রথমবারের মতো পাথর ও ইট দিয়ে স্থাপত্য নির্মাণের প্রমাণ পাওয়া যায়।
এএসআই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে —
এই পর্যায়েই প্রথমবার এই স্থানে পাথর ও ইটের নির্মাণ কাজ হয়েছিল। এই স্তরে পাওয়া বস্তুগুলির মধ্যে রয়েছে — টেরাকোটা মানুষ ও প্রাণীর মূর্তি, বালা-টুকরো, বল, চাকা, ব্রাহ্মী লিপিতে শুধু “শ্রী” অক্ষরযুক্ত একটি ভাঙা সিল পাথরের তৈরি চাকি (saddle quern), ঢাকনার অংশ, কাঁচের পুঁতি, হাড়ের হেয়ারপিন ও খোদাই করার যন্ত্র, এবং হাতির দাঁতের তৈরি পাশা (ivory dice)।

(মৌর্য বংশের শেষ সম্রাট বৃহদ্রথকে হত্যা করে তার প্রধান সেনাপতি ব্রাহ্মণ পুষ্যমিত্র শুঙ্গ সিংহাসনে বসেন এবং শুঙ্গ বংশের প্রতিষ্ঠা করেন।
বিভিন্ন গ্রন্থে পুষ্যমিত্রকে একজন বৌদ্ধ ধর্ম বিরোধী শাসক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। ক্ষমতা দখল করে প্রথমেই তিনি কুক্কুতারাম বৌদ্ধবিহার ধ্বংস করে ভিক্ষুদের হত্যা করেন। পুষ্যমিত্র কাশ্মীর সীমান্তে প্রায় পাঁচশত বৌদ্ধবিহার ধ্বংস করেন ও বহু ভিক্ষুকে হত্যা করেন। জন মার্শালের মতে সাঁচীর স্তুপ পুষ্যমিত্র শুঙ্গের রাজত্বকালে ধ্বংস হয় এবং পরবর্তী সম্রাট অগ্নিমিত্রের রাজত্বকালে পুনর্নির্মাণ করা হয়। পঞ্চদশ শতাব্দীর তিব্বতী লামা তারানাথ তার গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে, ব্রাহ্মণ রাজা পুষ্যমিত্র মধ্যদেশ হতে জলন্ধর পর্য্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় বৌদ্ধ মঠ ধ্বংস করেন ও বহু বৌদ্ধ পণ্ডিতকে হত্যা করলে সমগ্র উত্তর ভারত থেকে বৌদ্ধ ধর্ম অবলুপ্তির পথে চলে যায়। মহামতি সম্রাট অশোকের অনুশাসন বাতিল করে দিয়ে মনু সংহিতা রচনা করা হয়।
খুব সম্ভবত মৌর্য যুগথেকে তৈরি হওয়া অযোধ্য়ার বৌদ্ধ মঠটিও এই সময় পুষ্যমিত্র ধ্বংস করে দিয়েছিলেন।)
(iii) পর্ব – III : কুষাণ যুগ
এই পর্বটি খ্রিস্টীয় প্রথম থেকে তৃতীয় শতাব্দী-এর অন্তর্গত এবং এতে প্রচুর মৃৎপাত্র ও অন্যান্য নিদর্শন পাওয়া গেছে। যেমন টেরাকোটা প্রাণী ও মানব মূর্তি, বালা-টুকরো, পবিত্র জলাধারের টুকরো, হাড়ের হেয়ারপিন, কাঁচের পুঁতি, তামার অ্যান্টিমনি রড।

(বিখ্য়াত কুষাণ সম্রাট কণিষ্ক ৫৬ বছর রাজত্ব করেছিলেন এবং তিনি বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। কণিষ্কের স্বর্ণমুদ্রায় গৌতম বুদ্ধের প্রতিকৃতি পাওয়া গিয়েছে।
এই যুগে আলোচ্য় স্থানে বৃহৎ আকারের স্থাপনা নির্মাণ শুরু হয়েছিল — যা জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য নির্মিত ছিল বলে অনুমান করা হয়।)
(iv) পর্ব – IV : গুপ্ত যুগ
এই পর্যায়টি খ্রিস্টীয় চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত। এ সময়ের প্রমাণস্বরূপ টেরাকোটা মূর্তি ও একটি তাম্রমুদ্রা পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে —
এই স্তর গুপ্ত যুগের অন্তর্গত। এ স্তরে পাওয়া যায় ঐ যুগের টেরাকোটা মূর্তি এবং একটি তাম্রমুদ্রা — এর একপাশে রাজপুরুষের ছবি, অপর পাশে উপরে গরুড়-চিহ্ন ও নিচে ব্রাহ্মী লিপিতে “শ্রীচন্দ্র(গুপ্ত)” লেখা আছে। এই যুগের বৃহৎ কোনো স্থাপনার নিদর্শন এখানে পাওয়া যায়নি।
(এই যুগ ছিল ব্রাহ্মণ্য়বাদী ধর্মের উত্থানের যুগ। এই যুগে পুরাণ লেখা শুরু হয়। বৌদ্ধ ধর্ম রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা হারিয়ে কোনঠাসা হয়েপড়ে।)
(v) পর্ব – V : উত্তর-গুপ্ত / রাজপুত যুগ
এই পর্যায়টি খ্রিস্টীয় সপ্তম থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত। খননে এই সময়ের একটি বৃত্তাকার ছোট মন্দির বা সহায়ক দেবালয় (subsidiary shrine) উন্মোচিত হয়েছে।
(ইতিহাসে এই যুগে ব্রাহ্মণ্য়বাদী ধর্মের সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের চরম সংঘাত লক্ষ করা যায়। শঙ্করাচার্য এই যুগের লোক ছিলেন। এই সময় সারা ভারত যুড়ে হাজার হাজার বৌদ্ধ মঠ ধ্বংস করে হিন্দু মন্দিরে রুপান্তরিত করা হয়। লক্ষ্য লক্ষ্য বৌদ্ধ সন্যাসিকে হত্য়া করা হয়। এই যুগেই সর্বপ্রথম এখানে বিতর্কিত স্থানে কোন মন্দির নির্মানের প্রমান পাওয়া যায়।)
(vi) পর্ব – VI : প্রারম্ভিক মধ্যযুগ–সুলতানী আমল
এই স্তরটি খ্রিস্টীয় একাদশ–দ্বাদশ শতাব্দী-এর।
খননে যা পাওয়া গেছে —
ইট-চূর্ণ দিয়ে তৈরি এক মোটা মেঝে পাওয়া গেছে, যা একটি বিশাল উত্তর–দক্ষিণমুখী প্রাচীরের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এটি ঐ যুগের প্রধান নির্মাণ।
(vii) পর্ব – VII : মধ্যযুগ–সুলতানী আমল
এই পর্যায়টি খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।
এই সময়ে উত্তর–দক্ষিণ মুখী প্রায় ৫০ মিটার লম্বা একটি বিশাল কাঠামো নির্মিত হয়েছিল, কিন্তু এটি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এর উপর তিনটি নির্মাণপর্ব ও তিনটি তলাযুক্ত একটি বৃহদায়তন স্থাপনা তৈরি হয়, যেখানে পূর্ববর্তী কাঠামোর খোদাই করা স্তম্ভ ও অলংকরণ পুনরায় ব্যবহার করা হয়। এটি ছিল জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য নির্মিত একটি বিশাল স্তম্ভবেষ্টিত হল, যা দ্বাদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত স্থায়ী ছিল ।

(viii) পর্ব – VIII : মোগল যুগ
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে —
এই যুগেই বাবরি মসজিদটি তৈরি করা হয়েছিল।
VII–পর্বের (সুলতানি আমলের) উত্তর–দক্ষিণ প্রাচীরটি পেছনের দেওয়ালের ভিত্তি হিসেবে রাখা হয়েছে। ভিত্তির ভেতরে ও সামনে শক্ত মাটি চাপিয়ে তার উপর ধূসর কঙ্কর ও ছাই মিশ্রিত স্তর দেওয়া হয়েছে, যাতে নদীর ঝিনুক পোড়ানো অবস্থায় পাওয়া যায়। এই স্তরের পুরুত্ব ২০–২৫ সেমি, যা মোগল যুগের প্রথম তলার মেঝের নিচের শক্তি-স্তর (soling) হিসেবে কাজ করেছে।
(ix) পর্ব – IX : মোগল পরবর্তী যুগ
এই যুগে মসজিদটিতে কিছু সংস্কার কাজ করা হয়, মসজিদের চারপাশে প্রাচির নির্মাণ করা হয়। মসজিদের উত্তর-দক্ষিণ দিকে কিছু মৃতদেহ কবর দেওয়া হয়।
সারসংক্ষেপ
একই জায়গার উপর প্রায় ২০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন ধর্মীয় স্থাপনার বারবার নির্মাণ-বির্নির্মাণ-পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। সবার প্রথমে বৌদ্ধরাই এখানে মঠ নির্মাণ করে। কয়েকবার এই মঠ ধ্বংস হয়েছে আবার পুনর্নিমাণ করা হয়েছে। উত্তর গুপ্ত যুগ – রাজপুত যুগে বৌদ্ধ মঠ পুরোপুরি ধ্বংস করে তার উপর ছোট করে হিন্দু মন্দির নির্মান করা হয়।
মধ্যযুগে মুসলমান সুলতানদের আমলেই এখানে তিনটি তলাযুক্ত একটি বৃহদায়তন স্থাপনা তৈরি হয়, যেখানে পূর্ববর্তী কাঠামোর খোদাই করা স্তম্ভ ও অলংকরণ পুনরায় ব্যবহার করা হয়। এখানে জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য নির্মিত একটি বিশাল স্তম্ভবেষ্টিত হল পাওয়া গেছে। সুলতানি যুগে ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্যের বিকাশ ঘটেছিল, যেখানে হিন্দু অলঙ্করণ এবং ইসলামিক শৈলীর মিশ্রণ দেখা যায়। অলঙ্করণে জ্যামিতিক নকশা, লতাপাতা ও ফুলের মোটিফ এবং কোরানের বাণীর পাশাপাশি হিন্দু প্রতীক যেমন স্বস্তিকা, পদ্মফুল ও ঘণ্টা ব্যবহৃত হয়েছিল। এই মিশ্রণের একটি উদাহরণ হলো কুতুবউদ্দিন আইবকের নির্মিত কুবাতুল ইসলাম মসজিদ। এখানেও সুলতানি যুগের যে স্থাপনার অস্তিত্বের প্রমান পাওয়া গেছে, তাতেও এই ধরণের ইসলামিক অলঙ্করণের পাশাপাশি হিন্দু প্রতীকের দেখা পাওয়া গেছে।
সুলতানি যুগে তৈরি হওয়া এই স্থাপনার ভিত্তির উপরেই মুঘল যুগে বাবরি মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল। কোনো হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে বাবরি মসজিদ তৈরি হয়েছিল এমন কোন প্রমান পাওয়া যায় নি। বাবরি মসজিদ তৈরি হয়েছিল সুলতানি আমলে তৈরি হওয়া কাঠামোর উপর।
তাই হিন্দু মন্দির ভেঙে বাবরি মসজিদ তৈরি হয়েছিল — প্রাক্তন বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের এই মতামত ভুল এবং পক্ষপাত দুষ্ট, আমরা এই মত প্রত্যাক্ষান করি।
চন্দ্রচূড় আরও বলেছেন, কোন ধর্মীয় স্থাপনা ধ্বংস করে সেখানে অন্য কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান করা অপবিত্র কাজ — আমরা এর সঙ্গে ১০০% সহমত।
চন্দ্রচূড় এখানে হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে বাবরি মসজিদ নির্মাণের কথা বলছেন, কিন্তু তার কোনো নিশ্চিত প্রমান নেই। অথচ ভারতের বুকে অন্য ধর্মীয় স্থাপনার উপর হিন্দু ধর্মীয় পূজা-উপাসনা করার মত অপবিত্র কাজ এখনও চলছে, তার ঐতিহাসিক এবং বর্তমান প্রমান এখনও রয়েছে, — প্রাক্তন বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের এই ব্য়াপারে কোন বক্তব্য আমরা পাই না।

উদাহরন স্বরুপ পুরির বিখ্যাত মন্দিরের কথা বলা যেতে পারে। ঐতিহাসিকদের মতে পুরির জগন্নাথ মন্দির আসলে একটি বৌদ্ধ মন্দির, হিন্দুরা ওটাকে দখল করে নিয়েছে। স্বয়ং স্বামী বিবেকান্দ-ও একই কথা বলেছেন। স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা -এর পঞ্চম খন্ডে বলেছেন, “জগন্নাথ-মন্দির একটি প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির। আমরা ঐটিকে এবং অন্য়ান্য বৌদ্ধ মন্দিরকে হিন্দু মন্দির করিয়া লইয়াছি।”


বাঙালি সাহিত্যিক এবং গবেষক নারায়ণ সান্যালের লেখা “কলিঙ্গের দেব দেউল” বইতে আছে “ভাস্করেশ্ব মন্দিরের শিব লিঙ্গ আসলে একটি অশোক স্তম্ভ — সেখানে একটি বৌদ্ধ স্তুপও ছিল। সম্ভবত ভৌমক যুগে শৈবরা সেটিকে শিব মন্দিরে রূপান্তরিত করে। অশোক স্তম্ভকে করে শিবলিঙ্গ — স্তম্ভশীর্ষের সিংহটিকে সমাধিস্থ করে।”



তমলুকের ভূমিপুত্র যুধিষ্ঠির জানা-র লেখা বই “বৃহত্তর তাম্রলিপ্তের ইতিহাস”-এ আছে “বর্গভীমা মন্দির পূর্বে বৌদ্ধ-মন্দির ছিল, ব্রাহ্মণগণ কর্তৃক উহা কালী মন্দিরে পরিণত হইয়াছিল। ব্রাহ্মণগণ মহাসমারোহে ঐ মন্দির মধ্য়ে কালীমূর্তি সংস্থাপিত করে।”

এছাড়াও আমাদের পশ্চিমবঙ্গে আরও অনেক বৌদ্ধ ও জৈন মন্দির রয়েছে যেগুলোকে বিষ্ণু মন্দির, শিব মন্দিরে রূপান্তরিত করা হয়েছে। জৈন দেবতার মুর্তি ভেঙে শিবলিঙ্গ তৈরি করা হয়েছে। পুরুলিয়া জেলার কংসাবতী নদীর পাড়ে পাথরের তৈরি যে বিষ্ণু মন্দির – শিব মন্দির দেখা যায়, সেগুলো আসলেই জৈন মন্দির বলে ঐতিহাসিকরা নিশ্চিন্ত করেছেন।



তবুও আজকের দিনে পুরির জগন্নাথ-মন্দিরকে পুনরায় বৌদ্ধ মন্দিরে রূপান্তরিত করা, বা তমলুকের বর্গভীমা মন্দিরকে বৌদ্ধদের ফিরিয়ে দেওয়া, বা পুরুলিয়ার জৈন মন্দিরগুলিকে জৈনদেরকে ফিরিয়ে দেওয়া – এই ধরনের কাজ আজকের দিনে আমরা কেউই সমর্থন করব না। কারণ তাতে সমস্য়া-বিভেদ আরও বাড়বে বৈ কমবে না। হাজার চেষ্টা করলেও আমরা আর অতিতে ফিরে যেতে পারবনা।
অতিত সমালোচনার উর্দ্ধে নয়, কিন্তু অতিতকে দোষারোপ করে কোনো লাভ নেই। অতিত ইতিহাস থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারব, ইতিহাসকে বিকৃত করে নবিন প্রজন্মকে অজ্ঞতার আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করতে পারব, কিন্তু ইতিহাস কে আমরা পাল্টেদিতে পারবনা। ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) আজকে সেটাই করতে চাইছে, এবং চন্দ্রচূড়ের মত মানুষরা তাদেরই হাত শক্ত করছেন — এটা ভারতবাসীর দুর্ভাগ্য।
