বিজেপির বাঙালি বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বনাম তৃণমূলের মেকি বাঙালি জাতিয়তাবাদ। – বলির পাঁঠা প্রান্তিক বাঙালি।
বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর নিপীড়ন নতুন কোন খবর নয়, এর আগেও বহুবার এরকম হয়েছে। মেধাবি, পরিশ্রমী, সৃজনশীল বাঙালি শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে মুম্বাইয়ে, সুরাটে বাঙালি জরি শিল্পী, হিরা শিল্পী, স্বর্ণ শিল্পীদেরকে মারধর করে সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বাল ঠাকরের সময়ে মহারাষ্ট্রে কর্মরত বাঙালিদের ধরে জোর করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হোত।












কিন্তু বর্তমানে ভারতের বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে, বিশেষ করে উড়িষ্য়া, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, হরিয়ানা, অসম এবং দিল্লি–এই সব অঞ্চলে কাজ করতে যাওয়া বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকরা যেভাবে ক্রমাগত হেনস্তার শিকার হচ্ছেন, এরকমটা আগে কখনও হয়নি। সবরকম বৈধ পরিচয়পত্র যেমন ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, প্যান কার্ড, বার্থ সার্টিফিকেট, গ্রাজুয়েশন সার্টিফিকেট বা রেশন কার্ড ইত্যাদি থাকা সত্ত্বেও, শুধু নাম এবং ভাষার ভিত্তিতে তাঁদের ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ তকমা দিয়ে পুলিশি জুলুম ও প্রশাসনিক হয়রানির শিকার করা হচ্ছে।
অনেককে আটক করে মারধর করা হচ্ছে, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হচ্ছে। অনেককে জোর করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, অথচ তারা মালদা, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুর বা আসামের ধুবড়ি জেলার বাসিন্দা। যারা নির্যাতিত হচ্ছেন তারা সবাই একেবারে প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষ, ধণী বা একটু পয়সাওয়ালা কাউকে নিগ্রিহিত হতে হয়েছে, এরকমটা দেখা যায়নি।
খেটে খাওয়া একেবার গরিব প্রান্তিক মানুষ, বাইরের রাজ্যে গিয়ে গতর খাটিয়ে পরিশ্রম করে একটু যারা টাকা পয়সার মুখ দেখছে, তাদেরকে ভয় দেখিয়ে সর্বস্ব কেড়়ে নেওয়ার চক্রান্ত চলছে।
এই প্রসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন আমাদের সামনে আসছে।
১। বলা হচ্ছে কাশ্মিরের পহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসবাদী হামলার পর রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে ভারতে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করণের কাজ চলছে ভারত সরকারের নির্দেশ মেনেই।
কিন্তু, পহেলগাঁওয়ের সন্ত্রাসবাদীরা কেউই বাঙালী বা বাংলাদেশি ছিল না, তারা বাংলা ভাযায় কথা বলছিল না। তারা ছিল হিন্দু-উর্দুভাষি পাকিস্থানি। ভারতের কাশ্মির, পাজ্ঞাব, রাজস্থান ও গুজরাটের সঙ্গে পাকিস্থানের দীর্ঘ সিমান্ত রয়েছে, এই সিমান্ত অঞ্চলের লোকেরা হিন্দি-উর্দু ভাষায় কথা বলে। তাহলে ভারতে অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করণের নামে শুধু মাত্র বাঙালিদের কেন আটক করে হয়রানি করা হচ্ছে। হিন্দি-উর্দুভাষিদেরকে কেন কিছুই বলা হচ্ছে না। অথচ যুক্তি তো বলে, ভারতে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী এবং সন্ত্রাসবাদীদের আটকাতে হলে আগে হিন্দি-উর্দুভাষীদেরকেই আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা উচিৎ। সেটা না করে শুধু মাত্র বাঙালিদের উপর অত্যাচার, হেনস্থা করা হচ্ছে কেন? এটা-কি বিজেপির বাঙালি বিদ্বেষি হওয়ার পরিচয় নয়?
২। ভারতের কোন নাগরিক যদি বাইরের কোন দেশে গিয়ে বিপদে পড়ে, বা কোন রকম অন্যায় অত্যাচারের শিকার হয়, তবে ভারত সরকার সবসময় নিজের সেই বিপদগ্রস্থ নাগরিকের সাহায্যে এগিয়ে আসে। কোনরকম অন্যায় হলে ভারতের বিদেশ মন্ত্রক তার জন্য ব্যবস্থা নেয়, এমনকি আন্তর্জাতিক আদালত পর্যন্ত দৌড়ায়।
ভারতের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোন বাসিন্দা যখন রুজি রুটির জন্য় অন্য কোন রাজ্যে গিয়ে শুধু মাত্র বাঙালি হওয়ার জন্য অন্যায় অত্য়াচারের শিকার হয়, তখন রাজ্য সরকার কি ভূমিকা পালন করে ? পশ্চিমবঙ্গ সরকার আগেও কোনদিন নিজের বাসিন্দাদের পাশে দাঁড়ায়নি, আর এখনকার তৃণমুল সরকার যেটা করছে, সেটাকে হাস্যকর কু-নাট্যরঙ্গ বললেও কম বলা হয়।
ভারতের যে কোন রাজ্যে গিয়ে রুজি রোজগার করা প্রতিটা পশ্চিমবঙ্গবাসির সংবিধানিক অধিকার। এবং তাদের এই সংবিধানিক অধিকার যাতে লঙ্ঘিত না হয় সেটা দেখা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দায়িত্ব।
সমস্যাটা যখন পুরানো, তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দরকার ছিল ভারতের প্রতিটা রাজ্যে একজন রেসিডেন্ট অফিসার নিয়োগ করা। পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে যারা রাজ্যের বাইরে যাচ্ছন, তাদেরকে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে পরিচয় পত্র দেওয়া এবং সংস্লিষ্ট রাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত রেসিডেন্ট অফিসারের কাছে পরিযায়ী শ্রমিকদের সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্য জমা রাখা। তাহলে কোন বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকের পরিচয় নিয়ে কোন রাজ্যসরকারের সন্দেহ হলে তারা পশ্চিমবঙ্গের রেসিডেন্ট অফিসারদের কাছ থেকে তৎখনাত তথ্য পেয়েযেতে পারবেন। তারপরেও যদি কোন রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিকে বাংলাদেশি বলে হেনস্থা, নির্যাতন করে, তবে পশ্চমবঙ্গ সরকারের উচিৎ সেই রাজ্যের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে কেস করা এবং ক্ষতিপুরন আদায় করা। ভারত সরকার যদি নিজের নাগরিকদের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে পারে, তবে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কেন নিজের রাজ্য়ের পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য সুপ্রিমকোর্টে যায়না। এরআগেও এই বিশয়ে অনেক কথা হয়েছে, কিন্তু রাজ্য সরকার কোন ব্যবস্থা নেয় নি, জেলা শাসক, মহকুমা শাসকদের কাছেও তাদের জেলার পরিযায়ী শ্রমিকদের ব্যপারে কোন তথ্য নেই।
এর থেকে বুঝা যায় বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিদের নিয়ে তৃণমুল সরকার এতটুকু ভাবিত নয়। তৃণমুল যেটা করছে, সেটা ভোটের রাজনিতী। বাঙালি আবেগে সুড়সুড়ি দেওয়া হচ্ছে, বাংলা ভাষা আন্দোলন করার কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু WBCS পরীক্ষায় ৩০০ নম্বরের বাংলা বাধ্যতামূলক করা হয়নি। চাকরিতে ভূমিপুত্র সংরক্ষন নেই, আমলাদের ৭০ শতাংশই বহিরাগত, বাংলা এবং বাঙালির প্রতি তাদের কোন আবেগ অনুভূতি নেই।
এই সরকার নিজের রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকদের সংবিধানিক অধিকার রক্ষায় পুরোপুরি ব্যর্থ। কারণ সেই ইচ্ছাটাই তৃণমূল সরকারের নেই। সমস্যার সমাধান করার কোন ব্যবস্থা না করে, পরিযায়ী শ্রমিকদের বিজেপির ভয় দেখিয়ে রাজ্যে ফিরে আসার জন্য বলা হচ্ছে। বাঙালি মুসলমান পরিযায়ী শ্রমিকদের ভয় দেখিয়ে মেরুকরণ করে ২০২৬শে ভোট-বৈতরণী পার হওয়াটাই আসল লক্ষ্য।
বাংলরা মুখ্যমন্ত্রী পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফিরে আসতে বলছেন, বাংলাতেই কাজের ব্যবস্থা করার কথা বলছেন, কিন্তু শখ করে কেউ পরিযায়ী হয় না। এর আগে করোনা ভাইরাসের প্রকোপের সময়ও মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর মুখে এই ধরনের আশ্বাস আমরা শুনেছিলাম, অনেকেই আশ্বস্ত হয়ে দেশে থেকেই রুজি রোজগার করার কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু আমরা জানি করোনার প্রকোপ কমতেই আবার বাঙালিকে রুজি রুটির জন্য দলে দলে ভিন রাজ্য়ে পাড়ি দিতে হয়েছে। ২০২৬শে বিধান সভা ভোট হয়ে গেলেই আবারও বাঙালিকে প্রাণ হাতে করে পরিযায়ী হয়ে ভিন রাজ্যে কাজের খোঁজে বেরিয়ে পড়তে হবে।

৩। সবথেকে গুরুতর প্রশ্ন যেটা সেটা হল, পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের জনসংখ্যা যদি মাত্র ৩০শতাংশ হয় তবে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের ৮০শতাংশই কেন মুসলমান হয়। এর উত্তর কে দেবে?
ক) বাঙালি মুসলমান জনসংখ্যায় ৩০শতাংশ হলেও সরকারি চাকরিতে মাত্র ৫-৬ শতাংশ কেন? সম্প্রতি ৮৩শতাংশ মুসলমান অধ্যুশিত মুর্শিদাবাদ জেলার শামসেরগঞ্জে ৯জন সিভিক ভলান্টিয়ার নিয়োগ হয়েছে, তার মধ্যে মাত্র ১জন মুসলিম। এটা কিভাবে সম্ভব হল? এরপরও কি বুঝতে অসুবিধা হয় কেন বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে ৮০ শতাংশই মুসলিম হয়?
খ) সরকার মুসলমানকে চাকরি দেয় না, গ্রামে কাজ নেই, নিজেদের চাষ করার জমি নেই, তাই পরিযায়ী শ্রমিক হওয়াটাই বাঙালি মুসলমানদের ভবিতব্য। কিন্তু এখানেও একটা প্রশ্ন আছে – বাইরের রাজ্য থেকে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক বাংলার রাজধানি কলকাতায় কাজ করতে আসে, তাহলে জেলার বাঙালি মুসলমান কলকাতায় না এসে কাজের খোঁজে অন্য রাজ্য়ে যায় কেন?
মালদা, মুর্শিদাবাদ বা উত্তর দিনাজপুরের মত দুরের জেলা থেকে এসে কলকাতায় কাজ করতে গেলে থাকার জায়গার দরকার। কিন্তু কলকাতায় সবার থাকার জায়গা থাকলেও বাঙালি মুসলমানদের কোন থাকার যায়গা নেই। মধ্য কলকাতার বিহারি হিন্দুস্থানি গুন্ডা অধ্যুষিত এলাকার ঘিঞ্জি বস্তিতে শান্তি প্রিয় বাঙালি মুসলমানদের বর্তমান প্রজন্ম আর থাকতে চায় না। আর এর বাইরে উত্তর ও দক্ষিন কলকাতায়, ১৯৬৪সালে প্রায় ৭০হাজার বাঙালি মুসলমান পরিবারকে উচ্ছেদ করে তৈরি হওয়া বাংলাদেশি রিফিউজি কলোনি গুলোতে, এই রাজ্যেরই ভুমিপুত্র বাঙালি মুসলমাকে না ঘর ভাড়া দেওয়া হয়, না ফ্ল্য়াট বিক্রি করা হয়। গড়িয়া থেকে দক্ষিণেশ্বর পর্যন্ত বিস্তির্ন এলাকায়, হিন্দুস্তানি, গুজরাটি, পাঞ্জাবি, মাড়ওয়াড়ি সবার থাকার অধিকার আছে, ঘর ভাড়া নিতে পারে, ফ্ল্যাট কিনতে পারে, বাড়ি কিনতে পারে, কিন্তু বাঙালি মুসলমানের সে অধিকার নেই। এর পরিনতিতেই আজকের দিনে বাঙালি নিজের মাটিতেই ক্রমে ক্রমে সংখ্যালঘুতে পরিনত হচ্ছে। বাঙালির নিজের সভ্যতা সংস্কৃিতি ভয়ানক ভাবে হিন্দুস্থানি আগ্রাসনের শিকার। সম্প্রতি একটা পরিসংখ্যান দাবী করছে যে কলকাতায় বর্তমানে বাঙালির সংখ্যা ৫০ শতাংশেরও কম, এই সংখ্যা আরও কমছে এবং হিন্দি ভাষীদের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। এবং এই তথ্য কলকাতার ভদ্রলোকদের অজানা নয়, কিন্তু মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা মুসলমান বিদ্বেষ এতই প্রবল যে এর পরেও একজন হিন্দুস্থানিকে ফ্ল্যাট বিক্রি করতে, ঘর ভাড়া দিতে কোন আপত্তি নেই কিন্তু দূরের জেলা থেকে আসা একজন বাঙালি মুসলমানকে ফ্ল্যাট বিক্রি করা যাবে না, ঘর ভাড়া দেওয়া যাবে না। তাহলে বাঙালি মুসলমান যাবে কোথায়? পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে বাইরের রাজ্যে গিয়ে হাজার বার অত্যাচারিত নির্যাতিত হলেও ভাগ্যের খোঁজে আবারও পরিযায়ী শ্রমিক হওয়াটাই বাঙালি মুসলমানের ভবিতব্য। এবং তৃণমুল দলটা যদি লোকদেখানো মিথ্যা বাঙালি জাতিয়তাবাদের বুলি কপচানো বন্ধ করে যেটা করা দরকার সেটা না করে, তবে নিজের দেশে পরবাসী হওয়া বাঙালি জাতির ভবিতব্য।

উপসংহার:
শখ করে কেউ পরিযায়ী হয় না। মুখ্যমন্ত্রী বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের ফিরে আসার অনুরোধ করছেন, বাংলায় কাজের ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিচ্ছেন। কিন্তু এর আগে, করোনা পরিস্থিতিতেও তিনি এমন আশ্বাস দিয়েছিলেন, যার বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে ২০২৬ সালের ভোট মিটে গেলেই আবার বাঙালিকে পরিযায়ী হয়ে প্রাণ হাতে করে ভিন রাজ্যে ছুটতে হবে। তৃণমূল কংগ্রেস যদি সত্যিই বাঙালির স্বার্থরক্ষায় আন্তরিক হয়, তবে লোকদেখানো বাঙালি জাতীয়তাবাদের বুলি কপচানো বন্ধ করে বাস্তব সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী হতে হবে। তা না হলে, “নিজের দেশে পরবাসী” হওয়াই হবে বাঙালি জাতির ভবিতব্য।
