উগ্রপন্থি হিন্দুত্ববাদিদের আর একটা নতুন প্রপাগান্ডা “দ্য বেঙ্গল ফাইলস”। বিবেক অগ্নিহোত্রীর নির্দেশিত নতুন চলচ্চিত্র ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ সিনেমাটিকে সরাসরি ‘কমিউনাল প্রোপাগান্ডা’ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে, যা ১৯৪৬ সালের ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে-র দাঙ্গার ঐতিহাসিক ঘটনাকে বিকৃত করে মেজরিটেরিয়ান সেন্টিমেন্ট জাগানোর চেষ্টা করেছে বলে অভিযোগ।
‘The Hindu”র মতে – Vivek Agnihotri injects a booster dose of communal poison. Marked by compelling performances and inflammatory storytelling, unbridled propaganda of ‘The Bengal Files’ is designed to incite majoritarian anger.
“The New Indian Express”এর মতে – The film dramatises the communal riots that took place during the Direct Action Day in 1946 with gory, hyper-violent visuals and attempts to sensationalise reality.
প্রকৃত ঘটনা
১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট ভোরে অশান্তি শুরু হয়েছিল কিছু দুস্কৃিতীদের দ্বারা দোকান-পাঠ লুঠ ও খুন খারাবির মাধ্যমে। কিন্তু এই দাঙ্গা শেষ পর্যন্ত মুসলিম ও হিন্দুদের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষের রূপ নেয়, এবং ২০ আগস্ট পর্যন্ত পাঁচ দিন ধরে চলেছিল। ১৯৪৬ সালের আগস্টের কলকাতা হত্যালীলার (The Great Calcutta Killings) ঘটনাকে ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে গুরুতর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মধ্যে একটি বলে গণ্য করা হয়।
এই দাঙ্গায় কমপক্ষে চার থেকে পাঁচ হাজার লোক নিহত হয়। পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার পর দেখা যায়, উভয় পক্ষের কয়েক হাজার লোক নৃশংসভাবে নিহত হয়েছে। হত্যা শুরু হওয়ার দশ দিন পর এই ভয়ঙ্কর রাতের শহরের (city of dreadful night) ফুটপাতে তিন হাজারের বেশি মৃতদেহ পড়ে থাকে। মৃতদেহ পোড়ানোর জন্য শহরে যে ব্যবস্থা ছিল মৃতদেহের সংখ্যা তার তুলনায় অনেক বেশি ছিল। ফলে মৃতদেহ সংগ্রহ ও তা গণকবরে স্তূপীকৃত করার জন্য সরকারকে নিম্ন শ্রেণীর ডোমদের জড়ো করতে হয়।
পুলিশ ছিল অপর্যাপ্ত এবং অপ্রস্তুত। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ এবং সেনা অফিসারগণ দাঙ্গা দমন করার জন্য সেনা নামাতে প্রাথমিকভাবে দিধাগ্রস্ত ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুসলিম লীগের প্রাদেশিক সরকার কারফিউ জারির মাধ্যমে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ এবং অনেক দোদুল্যমানতার পর শহরের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারের জন্য ব্রিটিশ সেনা মোতায়েন করার পরই কেবল দাঙ্গা দমন করা সম্ভব হয়েছিল।

(১৬ই আগস্টের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুধু কলকাতাতেই সীমা বদ্ধ ছিল না। পার্শবর্তী শিল্পাঞ্চলগুলো হাওড়া, হুগলি, ২৪পরগণা, আসানসোলেও ছড়িয়ে পড়েছিল বহু মানুষ মারা গিয়েছিলেন যাদের হিসাব এখানে ধরাই হয়নি।)
প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীও সেই সময় পুলিশ কন্ট্রোল রুমে অনেক সময় কাটিয়েছিলেন, একই সাথে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের অধিকারীও ছিলেন। অভিযোগ করাহয় যে সোহরাওয়ার্দী কন্ট্রোল রুমে থেকে পুলিশের কাজে হস্তক্ষেপ করছিলেন, তাতে পুলিশ দাঙ্গা থামানোর জন্য স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারছিল না।
কলকাতার পুলিশ কমিশনার ডিআর হার্ডউইক তদন্ত কমিশনের সামনে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন: … “পরিস্থিতি অধ্যয়ন করার জন্য আমার খুব কম সময় ছিল, কারণ প্রধানমন্ত্রী সেখানে ছিলেন এবং সাথে সাথে আমার সাথে আলোচনায় বসতেন যে কেন আমি লোকদের উদ্ধার করতে পারি না বা পিকেটিং করতে পারি না – এই দুটি প্রধান বিষয় নিয়ে আমার সাধারণত অনেক তর্ক হত এবং তারপরে মুসলিম লীগের কিছু অন্যান্য কর্মকর্তা বা সংসদীয় সচিব সর্বদা প্রধানমন্ত্রী সাথে আসতেন এবং নিয়ন্ত্রণ কক্ষে গোলমাল হত কারণ তারা প্রায়শই নিজেদের মধ্যে তর্ক করতেন …. এই কারণেই আমি প্রধানমন্ত্রী তার বন্ধুদের সরিয়ে দিতে বলেছিলাম। আমি বেশিরভাগ লোককে বের করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলাম, কিন্তু আমি প্রধানমন্ত্রী বের করে দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারিনি কারণ আমার তা করার কোনও অধিকার ছিল না।” এখানে লক্ষণীয় যে পুলিশ কমিশনার একবারও বলেননি যে, প্রধানমন্ত্রী তার কাজে হস্তক্ষেপ করছিলেন এবং তাকে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে দিচ্ছিলেন না। তিনি তর্ক করার কথা বলেছেন, যা সেই পরিস্থিতিতে খুবই স্বাভাবিক ছিল, প্রধানমন্ত্রী বার বার সেনা নামানোর কথা বলছিলেন, তিনি দুুপুর ২ঃ৪৫মিনিটেই সেনা নামানোর অনুমতি দিয়েছিলেন, কিন্তু ব্রিটিশ সেনাকর্তারা কোনোভাবেই সেনা নামানোর পক্ষে ছিলেন না।
স্বরাষ্ট্র বিভাগের অতিরিক্ত সচিব পিডি মার্টিনের লেখা বিস্তারিত নোট থেকে প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। মার্টিন ইতিমধ্যেই গত দশ বছর ধরে পুলিশ প্রশাসন, সামরিক যোগাযোগ, বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থা গঠন ইত্যাদির দায়িত্বে থাকা উপ-সচিব, যুগ্ম এবং অতিরিক্ত সচিবের পদে কাজ করেছেন। অন্য কথায়, তিনি স্বরাষ্ট্র নিরাপত্তা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। ১৬ আগস্ট থেকে শুরু করে চার দিন ধরে, এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তার বেশিরভাগ সময় কলকাতা পুলিশের কন্ট্রোল রুমে কাটিয়েছেন, প্রধান সচিব, সামরিক ও পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের সাথে পরামর্শ করে ভয়াবহ দাঙ্গা মোকাবেলার জন্য একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মার্টিন তার বিশদ নোটে, যা প্রায় ২০ পৃষ্ঠার, কেবল চার বা পাঁচটি ছোটখাটো বিষয়ে সোহরাওয়ার্দীর কথা উল্লেখ করেছেন, একটি ব্যতিক্রম যখন সোহরাওয়ার্দী ব্রিটিশ প্রধান সচিবের মুখোমুখি হন এবং ১৬/১৭ তারিখের মধ্যরাতে সেনাবাহিনী ডাকার জন্য জোর দেন। মার্টিনও তার নোটে পুলিশের কাজে প্রধানমন্ত্রীর হস্থক্ষেপের কথা বলেনন। তাই সোহরাওয়ার্দী পুলিশের কাজে হস্তক্ষেপ করছিলেন – এই অভিযোগ একেবারেই মিথ্যা রটনা।
অনেক ঐতিহাসিক – সমালোচক গণহত্যার যাবতীয় দায় প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর উপর চাপিয়ে দেন, কিন্তু সেই সময় বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নামেই প্রধানমন্ত্রী, আসল ক্ষমতা – পুলিশ, সেনাবাহিনী সবকিছুই নিয়ন্ত্রন করতো ব্রিটিশ অফিসারেরা, আর ব্রিটিশ পুলিশ ও সেনা কমান্ডাররা সেদিন কতটা দ্বিধাগ্রস্থ ছিল নিচের সারণী দেখে তা অনুমান করা যেতে পারে।
পুলিশ কন্ট্রোলরুম
১৬ আগস্ট
সকাল ৭.০০ টায় প্রথম সংঘর্ষের খবর আসে।
১৯৪৬ সালের গোড়ার দিকে প্রবর্তিত ‘জরুরি ব্যবস্থা পরিকল্পনা’ অনুসারে সকাল ৮.০০ টায় রাস্তা থেকে পুলিশ বাহিনী প্রত্যাহার করা হয়।
দুপুর ২.৩০ মিনিটে পুলিশ কমিশনার হার্ডউইক সামরিক সহায়তার জন্য আবেদন করার সিদ্ধান্ত নেন।
দুপুর ২.৪০ মিনিটে গভর্নর বারোজ সেনা মোতায়েনের অনুমোদন দেন।
দুপুর ২.৪৫ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী সেনা মোতায়েনের ব্যাপারে সম্মতি দেন।
বিকাল ৩.০০ টায় বারোস, হার্ডউইক এবং এরিয়া কমান্ডার সিক্সস্মিথ পরিস্থিতি উপলব্ধি করার জন্য শহরটি ঘুরে দেখেন।
৪.১৫ pm বারোজ এবং অন্যান্যরা সিদ্ধান্ত নেন যে পরিস্থিতি সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষে যুক্তিসঙ্গত নয় এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে সৈন্যদের শিয়ালদহ ক্যাম্পে আনা উচিত।
বিকেল ৫.৩০ মিনিটে সোহরাওয়ার্দী সিক্সস্মিথের সাথে দেখা করেন, শহরে সামরিক পিকেট স্থাপনের দাবি জানান। সিক্সস্মিথ তা প্রত্যাখ্যান করেন।
সন্ধ্যা ৭.০০ টায় একজন ভারতীয় ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসারকে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে এবং সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ কিনা তা নির্ধারণ করতে পাঠানো হয়। হার্ডউইককে জানানো হয় যে সেনাবাহিনী ডাকার কথা। তবে, ফোর্টের কমান্ডার ম্যাককিনলে হস্তক্ষেপ করেন এবং হার্ডউইককে বলেন যে তিনি চান অবিলম্বে সেনাবাহিনী মোতায়েন না করা হোক।
রাত ৯.০০ টায় কারফিউ জারি করা হয়।
রাত ১০.৩০ মিনিটে প্রধান সচিব ওয়াকার পুলিশ কন্ট্রোল রুম ত্যাগ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, কিন্তু সোহরাওয়ার্দী প্রতিবাদ করেন। পরিস্থিতির একটি গুরুত্ব সহকারে মূল্যায়ন শুরু হয়।
রাত ১১.৩০ মিনিটে সোহরাওয়ার্দী, ওয়াকার, ম্যাককিনলে এবং হার্ডউইক একমত যে সেনাবাহিনী উত্তর কলকাতায় ‘টহল’ দেবে।
১৭ আগস্ট
১.৪৫ মিনিটে শিয়ালদহ ক্যাম্প থেকে প্রথম সামরিক ‘টহল’ পাঠানো হয় জনতার উপর গুলি না চালানোর স্পষ্ট নির্দেশ দিয়ে।
সকাল ১১.০০ টায় বারোস, ওয়াকার, সিক্সস্মিথ, ম্যাককিনলে এবং হার্ডউইক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার জন্য দ্বিতীয় সফরে বেরিয়ে পড়েন। উত্তর কলকাতার পরিস্থিতি এতটাই খারাপ দেখতে পান যে তারা তাদের পরিদর্শন মাঝপথে ছেড়ে দেন এবং দ্রুত ফিরে এসে এলাকায় ‘আধিপত্য বিস্তার’ করার জন্য সৈন্যদের নির্দেশ দেন।
বিকাল ৩.৩০ মিনিটে তিনটি ব্রিটিশ ব্যাটালিয়ন উত্তর কলকাতার সবচেয়ে খারাপ অঞ্চলে প্রবেশ করে।
বিকাল ৫.৩০ মিনিটে সেনাবাহিনী অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ নেয়, দাঙ্গা অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।
১৮ আগস্ট
ভোর ২.০০ টায় সৈন্যদের ডক এলাকায় পাঠানো হয়। পরে ভোরে, সেনা কমান্ডার বুচার রাঁচি থেকে আসেন।
সকাল ১০.০০ টায় ব্যারাকপুর এবং নৈহাটিতে সৈন্য পাঠানো হচ্ছে।
সকাল ১১.৩০ মিনিটে বুচার, ভারতীয় মন্ত্রিসভার মন্ত্রী এবং ব্রিটিশ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে কলকাতা জুড়ে কৌশলগত স্থানে সামরিক পিকেট স্থাপন করা হবে। দুপুরে বুচার, বারোজ, সোহরাওয়ার্দী এবং ওয়াকার পরিদর্শনের তৃতীয় সফর শুরু করেন এবং পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে দেখতে পান। বিকেল ৪.৩০ মিনিটে পনেরো থেকে বিশটি ট্যাঙ্ক নিয়ে একটি ব্রিটিশ রিজার্ভ ব্যাটালিয়ন আপার চিতপুর রোডে প্রবেশ করে।
মোটকথা, ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের প্রাথমিক কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মনস্থির করতে কমপক্ষে একুশ ঘন্টা (১৬ আগস্ট দুপুর ২.৩০ টা থেকে ১৭ আগস্ট সকাল ১১.৩০ টা পর্যন্ত) সময় লেগেছিল। তারা প্রথম দিন সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিতে ডুবে ছিল, ১৮ আগস্ট সকালে সেনা কমান্ডার বুচারের আগমনের পরই সর্বাত্মক প্রচেষ্টা শুরু হয়।
আগস্টের হত্যাকাণ্ডর প্রেক্ষাপট
ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকেই হিন্দুরা সরকারি চাকরি, এবং সরকারের সমস্ত বিভাগেই নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রেখে আসছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার সম্প্রদায়গত রোয়েদাদ ঘোষণার পর স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। উদীয়মান মুসলিম গ্রুপগুলো হিন্দু ভদ্রলোক কর্তৃত্বকে ক্রমাগত চ্যালেঞ্জ করতে থাকে। পূর্ব বাঙলার মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোর স্থানীয় ও জেলা বোর্ডে মুসলমান প্রতিনিধিত্বের সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এমনকি পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে হিন্দুরা সংখ্যায় বেশি থাকা সত্ত্বেও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারি প্রতিষ্ঠানে মুসলিম প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
স্থানীয় প্রতিষ্ঠান তথা ইউনিয়ন, স্থানীয় ও ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড এবং পৌরসভায় আগে সাধারণত হিন্দু ভদ্রলোকেরাই ক্ষমতায় ছিল, তারা এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়। প্রায় ক্ষেত্রেই এর ফল দাঁড়ায় সাম্প্রদায়িক বিরোধ, এবং অনেক সময় তা সংঘর্ষে পরিণত হয়। স্কুল বোর্ডগুলোতেও একই ধারা পরিলক্ষিত হয় – অতীতে এসব বোর্ড ভদ্রলোকদের কুক্ষিগত ছিল। এমনকি ভদ্রলোকদের চিরাচরিত ঘাঁটি ঢাকাতেও হিন্দুরা তাদের হাত থেকে পৌরসভা ও স্কুলের নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়া রোধ করতে ব্যর্থ হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানো ভদ্রলোক হিন্দুদের জন্য সত্যি অসহনীয় ছিল, কারণ তারা নিজেদেরকে বাঙলার বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অভিভাবক হিসেবে গণ্য করত।
হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলোর হিন্দু ভদ্রলোকেরা আশা করেছিল যে, প্রাদেশিক পর্যায়ে তারা যে ক্ষমতা হারিয়েছে সেটা তারা স্থানীয় পর্যায়ে অধিকতর ভূমিকা রেখে পুষিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু তা অসম্ভব বলে প্রমাণিত হয়। এর পরিবর্তে তারা দেখতে পায়, সব ক্ষেত্রেই, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলোতেও তারা মুসলমানদের কাছে হেরে যাচ্ছে।
হিন্দু মহাসভার প্ররোচনা
এই অবস্থা পরিবর্তনের লক্ষ্যে বঙ্গের আইনসভায় হিন্দুদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য ১৯৩১ সালে হিন্দু মহাসভা উপজাতীয়দের উচ্চ শ্রেণীর হিন্দু নাম গ্রহণের এবং পরবর্তী আদমশুমারিতে ‘ক্ষত্রিয়’ হিসেবে নাম তালিকাভুক্তির জন্য প্রচার পুস্তিকার মাধ্যমে আহ্বান জানায়। মুঙ্গেরে এক জনসভায় সাভারকার পাঁচটি সাঁওতাল ছেলেকে হিন্দু সম্প্রদায়ে গ্রহণ করে নেন।
কিছু কিছু এলাকায় এ ধরনের কার্যকলাপে রাজনীতিতে ভিন্ন ধরনের প্রভাব দেখা দেয়। উত্তরবঙ্গের মালদা জেলায় মুসলমান জোতদারেরা ছিল বিশেষভাবে ক্ষমতাশালী। মুসলমানদের জমিতে কাজ না করার জন্য হিন্দু মহাসভা কর্মীরা আদিবাসী শ্রমিক ও ভাগচাষিদের প্ররোচিত করার চেষ্টা করে। তাদের প্রচেষ্টায় ‘সাঁওতাল, রাজবংশী, তুরী ও একই শ্রেণীর অন্যান্য লোক ‘মুসলমানদের’ অধীনে কাজ করা থেকে বিরত থাকে।
এ সময় অনেক হিন্দু সংগঠনের উন্মেষ ঘটে এদের সবার উদ্দেশ্য হল হিন্দু সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করা। ১৯৩৯ সালের জানুয়ারি মাসে বঙ্গীয় হিন্দু সংহতি প্রতিষ্ঠিত হয়, এর উদ্দেশ্য ছিল “বাঙলার হিন্দুদের অধিকার, আইনগত স্বার্থ ও সুযোগ-সুবিধা রক্ষা করা এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের সব শ্রেণীর মধ্যে সংহতি বৃদ্ধি করা”। ঐ বছরের মার্চ মাসে এই সংগঠনের লোকেরা কোলকাতায় বলেন যে, “আদিবাসী গোষ্ঠীর লোকদের হিন্দু হিসেবে পরিচিতির প্রয়োজন আছে” এবং তারা এই সংগঠনের কাজে যোগ দেওয়ার জন্য প্রদেশের হিন্দু জমিদারদের কাছে আহ্বান জানায়। এ ধরনের প্রস্তাবে নিম্ন বর্ণের অনেক সংগঠন আগ্রহের সাথে সাড়া দেয়। তাদের শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে গ্রহণের এবং তাদের সামাজিক আশা-আকাঙ্ক্ষার স্বীকৃতি লাভের জন্য তারা খুবই আগ্রহী ছিল।
এসবই ছিল মুলত হিন্দুদের সংখ্যা বাড়িয়ে বঙ্গের আইন সভায় হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের জন্য একটি বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশবিশেষ। ১৯৪১ সালের আদমশুমারি ও বর্ণ হিন্দুদের উদ্দীপনার সাথে নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের ধর্মান্তরকরণ একই সময় ঘটে।
সাধারণভাবে নিম্ন শ্রেণীর হিন্দুরা, বিশেষ করে বিশুদ্ধতর শাস্ত্রীয় মর্যাদার স্বীকৃতির জন্য যারা আগে থেকেই দাবি জানিয়ে আসছিল তারা কৃতজ্ঞচিত্তে প্রস্তাবিত ‘হিন্দু’ পরিচিতি গ্রহণ করে। বাঙ্গালির দুর্ভাগ্য যে এদেশে হিন্দুদের মধ্যে বর্ণভেদ, জাতিভেদ দূর করে সমান সামাজিক মর্যাদা – অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন কখনও হয়নি। যারা জলচল ছিলনা তারা জলচল হওয়ার জন্য আন্দোলন করেছে, যারা জলচল ছিল তারা ক্ষত্রিয় হওয়ার জন্য আন্দোলন করেছে, যারা ক্ষত্রিয় ছিল তারা ব্রাহ্মণ হওয়ার জন্য আন্দোলন করেছে। তাই হিন্দু মহাসভার এই শুদ্ধি কর্ম কৌশল বাঙলার জন্য উপযোগী ছিল।
অতিতে আদিবাসীদের সঙ্গে মুসলমানদের বিরোধের সেরকম কোন ইতিহাস আমরা পাই না। কিন্তু চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে আদিবাসীদেরকে হিন্দু রাজনীতিতে আনার প্রয়াস যখন চরম আকার ধারণ করে, তখন আদিবাসী ও মুসলমানদের মধ্যে অনেক আক্রমণ পাল্টা আক্রমণের ঘটনা ঘটে। ১৯৪১ সালের প্রথম দিকে ‘রাজশাহীতে একটা মসজিদের সামনে গানবাদ্যসহ একটা সরস্বতী পূজা মিছিল অতিক্রম করার সময় স্থানীয়ভাবে উত্তেজনা দেখা দেয়’। বসন্তকালে সরস্বতী পূজা হল মূলত বাঙ্গালী হিন্দু ভদ্রলোকদের পূজা। কিন্তু এবার ‘প্রায় দু’হাজার আদিবাসী তীর-ধনুক বা লাঠি নিয়ে সরস্বতী পুজার মিছিলে যোগ দেওয়ায় বাড়তি উত্তেজনা দেখা দেয়’। পূজায় আদিবাসীদের এভাবে অংশগ্রহণে এই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, ভদ্রলোক হিন্দুরা তাদের ইচ্ছানুযায়ী হিন্দু ‘সংস্কৃতি’ আদিবাসীদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ায় সফল হয়েছে এবং সাম্প্রদায়িক বিবাদে আদিবাসীদেরকে ব্যবহার করছে।
দুই মাস পর বার্নপুরের কাছে নরসিংহবাদে একটা বড় ধরনের সংঘর্ষ অতি অল্পের জন্য এড়ানো যায়। গোয়ালা শ্রেণীর সদস্যরা আসানসোল থেকে বার্নপুর গো-মাংসের বাজারে গো-মাংস বহন করে নিয়ে যাওয়ায় মুসলমানদের বাধা দিতে শুরু করে, অথচ তারা কোনরকম আপত্তি ছাড়াই এটি দীর্ঘদিন ধরে করে আসছিল।
১৯৪৫ সালের জানুয়ারি মাসে দিনাজপুর জেলার লালবাগ এলাকায় নামাজের সময় স্থানীয় মসজিদের পাশ দিয়ে সাঁওতালদের নেতৃত্বে কালী পূজা উপলক্ষে মিছিল অতিক্রম করাকে কেন্দ্র করে’ মুসলমান ও আদিবাসীদের মধ্যে একটা গোলমালের আশংকা দেখা দেয়; ঐ একই বছর যশোরের লোহাগড়া থানা এলাকায় মিঠাপুর বাজারে নমঃশূদ্র ও মুসলমানেরা পরস্পরের বিরুদ্ধে মারাত্মক সংঘর্ষের মুখোমুখি হয়।
হাটবারের দিন নামাজ পড়ার সময় মসজিদের সামনে দিয়ে একটা মূর্তি নিয়ে যাওয়ার সময় বেশ কিছু নমঃশূদ্র গান গাচ্ছিল এবং নাচছিল। মসজিদে অবস্থানরত মুসলমানেরা তাদেরকে চলে যেতে বলে এবং তারা চলে যায়। পরদিন প্রায় চার হাজার নমঃশূদ্র ঢাল-সড়কি নিয়ে আসে এবং মসজিদের সামনে পুনরায় নাচতে ও গাইতে থাকে এবং কোনরকম বাধা ছাড়াই তারা চলে যায়, কারণ মুসলমানেরা প্রস্তুত ছিল না। এ ঘটনার পর মুসলমানেরা আশপাশের গ্রামের মুসলমানদের সংগঠিত করে এবং নমঃশূদ্রেরা আবার আসলে দলবদ্ধভাবে তাদের আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকে।
হিন্দুপ্রধান যেসব এলাকায় হিন্দুদের কর্তৃত্ব ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছিল, সেসব এলাকায় বিরোধ বিশেষভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৯৩৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এ সময় কালনা মহকুমার দেয়ারা শহরের মুসলমানেরা একটা গরু কুরবানি করে ঈদ উৎসব পালন করে। দেয়ারা শহরে আগে কখনো কুরবানি করা হয়নি। এ ঘটনায় কালনার হিন্দুরা উত্তেজিত হয় এবং এটাকে তারা মুসলমান সম্প্রদায়ের উসকানিমূলক কাজ বলে মনে করে। বর্ধমান শহরের হিন্দুরা এর প্রতিশোধ গ্রহণ করে তারা জোরপূর্বক মুসলমানদের গরু কুরবানি থেকে বিরত রাখে, যদিও বর্ধমানের মুসলমানেরা বকরা ঈদের সময় ঐহিত্যগতভাবে প্রতি বছর গরু কুরবানি দিয়ে আসছিল। এই ঘটনার পর একটা হিংসাত্মক সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব হলেও দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে চাপা ক্ষোভ কিন্তু বিরাজ করতেই থাকে। পরের বছরে দুর্গা পূজার প্রতিমা বিসর্জন অনুষ্ঠানের সময় মসজিদের সামনে বাজনা বাজানোকে কেন্দ্র করে বর্ধমান শহরে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। সন্ধ্যা ৮টা ৪০ মিনিটের সময় বড় বাজার এলাকার মসজিদের সামনে মিছিল উপস্থিত হয়। এই মিছিলে বাঁশি ও ঢোল বাজানো হচ্ছিল। এ সময় মসজিদের মধ্যে মুসলমানেরা নামাজ পড়ছিল। তারা এটা দেখে রাগান্বিত হয় এবং উভয় পক্ষই সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এ সংবাদ খুব দ্রুত বেড়িখানা মসজিদে গিয়ে পৌঁছায়। সেখান থেকে একদল মুসলমান লাঠি নিয়ে ছুটে আসে এবং ঐ পথ দিয়ে প্রতিমা নিয়ে যেতে দিতে বাধা দেয়। উভয় পক্ষে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয় – মুসলমানেরা দৃঢ়তার সাথে জানায় যে, মসজিদের সামনে কোনো সময় বাজনা বাজানো যাবে না। হিন্দু মিছিলকারীরা রাস্তার পাশে মূর্তি ফেলে রেখে অত্যন্ত রেগেমেগে ঐ স্থান ত্যাগ করে। স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট এই ঘটনায় হস্তক্ষেপ করেন। মুসলমানেরা শেষ পর্যন্ত রাত দশটার পর মসজিদের সামনে বাজনা বাজানোর অনুমতি দিতে সম্মত হয়। অতঃপর অতি দেরিতে গভীর রাতে মিছিলকারীরা ঐ পথ দিয়ে মিছিল করে চলে যায়।
একই ধরনের ঘটনা অন্যান্য হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলোতেও ঘটে। ১৯৩৪ সালে ২৪ পরগণা জেলার কাকদ্বীপ থানায় মোল্লারচকে একটা বড় ধরনের বিরোধ বাধে। বর্ধমান জেলার মতো ২৪ পরগণা জেলাও ছিল অন্যদের জেলার চেয়ে অধিক নগরকেন্দ্রিক এবং এখানে প্রচুর শিক্ষিত হিন্দুর বাস ছিল। কিন্তু স্থানীয় রাজনীতির ওপর শিক্ষিত হিন্দুদের প্রভাব প্রতি বছরই শিথিল হয়ে আসছিল। এমনকি বর্ধমান জেলার চেয়ে ২৪ পরগণা জেলায় স্থানীয় বোর্ডগুলোতে মুসলমান সদস্য সংখ্যা দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পায়। বশিরহাট ও বারাসাত মহকুমায় জনসংখ্যার আনুপাতিক হারের থেকে মুসলমান সদস্য ছিল অনেক বেশি। ১৯৩২ সাল নাগাদ মুসলমানেরা বারাসাত বোর্ডে হিন্দু সদস্যদের সাথে সমতা অর্জন করে, যদিও এটা ছিল হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা ।
১৯৩৩ সালে উত্তর কোলকাতার বেহালায় একটা বড় ধরনের কলহ সৃষ্টি হয়। ঈদের সময় ‘কুরবানি করার জন্য একদল মুসলমান শাপোরের দিকে কিছু পশু নিয়ে যাচ্ছিল। বেশ কিছু হিন্দু ও শিখ এ সময় তাদের ওপর পূর্ব পরিকল্পিত আক্রমণ চালায়’। এতে দু’পক্ষের মধ্যে যে মারামারি হয় তাতে বহু লোক মারাত্মক আহত হয়।
১৯৩৪ সালে ডায়মন্ড হারবার মহকুমার কাকদ্বীপ থানার কাছে মোল্লারচরে এক দাঙ্গা সংঘটিত হয়। এখানে ‘মুসলমানেরা গরু কুরবানি করার ইচ্ছার কথা ঘোষণা করে আর সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা তা বন্ধ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকে’। এর আগে এখানে কোনো সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দেখা যায়নি। গরু কুরবানি করার ইচ্ছায় হিন্দুরা ক্রুদ্ধ হয়। গরু কুরবানিকে তারা হিন্দুপ্রধান এলাকাকে অপবিত্র করার নজিরবিহীন কাজ হিসেবে গণ্য করে। পার্শ্ববর্তী মেদিনীপুর জেলাতেও
১৯৩৫ সালে একই ধরনের ঘটনা ঘটে। খড়গপুরের বারহোলা থানায় সামান্য একটা ঘটনা থেকে বিরোধ ছড়িয়ে পড়ে। কারণ, মুসলমানেরা গরু কুরবানি করার জন্য নতুন উদ্যোগ নিলে ‘হিন্দুদের অনুভূতিতে মারাত্মকভাবে আঘাত লাগে। বর্ধমান ও ২৪ পরগণা জেলার মতো মেদিনীপুরও ছিল হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা এবং ভদ্রলোক রাজনীতির প্রধান ঘাঁটি।
১৯৪৬এর নির্বাচন মুসলিম লীগকে পুনরায় বাঙলায় ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনে। ১৯৪৬ সালের এপ্রিল মাসে সোহরাওয়ার্দী সরকার গঠন করে বাঙলার নতুন প্রধানমন্ত্রী হলেন। ১৯৪৫-৪৬ সালের শীতকালে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়া ছাড়া ব্রিটিশদের আর কোন উপায় নেই।
এই সময় দিল্লিতে কংগ্রেস মুসলিম লীগকে বাদ দিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করার চেষ্টা করছিল। সোহরাওয়ার্দী কংগ্রেসকে এই বলে সতর্ক করে দেন যে: লীগকে কৌশলে পাশ কাটিয়ে কংগ্রেসকে ক্ষমতায় বসানোর সম্ভাব্য পরিণতি হবে বাঙলার পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা । তিনি বাংলার পুরোপুরি স্বাধীনতা ঘোষণার হুমকি দেন।
কিন্তু হিন্দুমহাসভার কাছে বাংলার পুরোপুরি স্বাধীনতা ঘোষণার অর্থ হল চিরকালের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ইচ্ছার অধীনে থাকা ।
গণহত্যার প্রস্তুতি
এই প্রেক্ষাপটে কুখ্যাত কোলকাতা হত্যাযজ্ঞ (Great Calcutta Killing) সংঘটিত হয়। কোলকাতা হত্যাযজ্ঞ একটা আকস্মিক কোন ঘটনা ছিল না। হতাহতের এই উদ্বেগজনক সংখ্যা এবং সহিংসতার অভূতপূর্ব তীব্রতা থেকে একটা বিষয় খুব পরিস্কার হয় যে, এই দাঙ্গা ছিল পূর্ব পরিকল্পিত এবং কিছু মানুষ দাঙ্গা এবং গণহত্যার পূর্ব প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছিল। সমগ্র বাঙ্গলাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান শাসনে যাওয়া থেকে প্রতিরোধ করতে হিন্দুরা আগে থেকে তৈরী হয়েই ছিল। ঐ লড়াইয়ে হিন্দুর চেয়ে অনেক বেশি মুসলমান নিহত হয়। প্যাটেল ঐ বীভৎস বিষয়টিকে এভাবে মূল্যায়ন করেন: “হিন্দুরা এতে তুলনামূলকভাবে বেশি লাভবান হয়েছে।”
মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্টকে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। সারা ভারতজুড়ে সার্বিক হরতাল – বন্ধ ডাকা হয়। বংলায়. মুসলিম লীগ এই বন্ধ সফল করার জন্য় সবরকমের প্রচেষ্টা চালায়। এর বিপরীতে হিন্দু মহাসভা ও তার সহযোগি দলগুলো যে কোনো মূল্যে বন্ধ ব্যার্থ করার জন্য ঐক্যবদ্ধ ভাবে বদ্ধপরিকর ছিল। ১৬ আগষ্ট ভোরে উত্তেজনা শুরু হয় যখন লীগের স্বেচ্ছাসেবকেরা উত্তর কলকাতায় হিন্দু ব্যবসায়ীদের দোকানপাট বন্ধ রাখতে বাধ্য করে এবং হিন্দুরা এর সমুচিত প্রতিশোধ হিসেবে লীগের শোভাযাত্রাসমূহের পথে বাধার সৃষ্টি করে। ওই দিন অক্টারলোনি মনুমেন্টে লীগের সমাবেশ এ যাবৎকালের মধ্যে মুসলমানদের সর্ববৃহৎ জমায়েত ছিল। এই ‘দিন’-টিকে সাফল্যমন্ডিত করতে লীগ তার সকল সম্মুখ প্রতিষ্ঠানকে প্রস্তুত রেখেছিল। অন্যদিকে, মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা মার্কিন সৈন্যদের নিকট থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলা-বারুদ কিনে জমা করে রেখেছিল, যেগুলি পরে দাঙ্গার সময় ব্যবহার করা হয়। দাঙ্গা আরম্ভের বহু পূর্বে হিন্দুদের মালিকানাধীন ফ্যাক্টরিসমূহে এসিড বোমা তৈরি করা ও মজুদ রাখা হয়। বল্লম ও অন্যান্য অস্ত্রপাতি তৈরি করার জন্য কলকাতার হিন্দু কামারদের প্রস্তুত রাখা হয়।
রাজনৈতিক দলগুলির ভূমিকা
ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে-তে রাজনৈতিক সংঘর্ষের আশঙ্কায়, দুই জাতীয়তাবাদী দল, মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেস ব-কলমে হিন্দু মহাসভা, ব্যাপক প্রচার এবং প্রচারনা চালিয়েছিল। সংবাদপত্রগুলিতে স্পষ্ট প্রচারণা চালানো হয়েছিল, উস্কানিমূলক লিফলেট ছাপানো হয়েছিল, স্থানীয়ভাবে প্রচুর সংখ্যক ছোট সমাবেশ করাহয়েছিল এবং শহরের কেন্দ্রস্থলে কয়েকটি গণ সমাবেশের আয়োজন করাহয়েছিল। ১৯৪০-এর দশকে এই ধরণের রাজনৈতিক প্রচারনার অভিনব বিষয় ছিল যে জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদদের অধীনে ‘স্বেচ্ছাসেবক’ নামে আধাসামরিক দল সংগঠিত করা।
বিশ্বযুদ্ধ এবং তার পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল সকল ধরণের ‘স্বেচ্ছাসেবক’ সংগঠনের অসাধারণ বৃদ্ধি। মূলত, ‘স্বেচ্ছাসেবক’ শব্দটি রাজনৈতিক দলের কর্মীদের বোঝায়, যারা নীতিগতভাবে বিনা পারিশ্রমিকে রাজনৈতিক সমাবেশ এবং সম্মেলন, সামাজিক কাজ, দুর্ভিক্ষ বা বন্যার্তদের ত্রাণ প্রচেষ্টা, সাধারণ নজরদারি ইত্যাদির রসদ সরবরাহ করত। ১৯২০-এর দশকের গোড়ার দিকে তারা রাজনৈতিক দলের সংগঠনের একটি স্থিতিশীল উপাদান হয়ে ওঠে; এবং ১৯৩০-এর দশকের শেষের দিকে তাদের একটি অংশ আধাসামরিক বাহিনীতে পরিণত হয়। অল-ইন্ডিয়া মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডস, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ, খাকসার, কংগ্রেস ভলান্টিয়ার কর্পস, হিন্দুস্থান ন্যাশনাল গার্ডস, আজাদ হিন্দ ভলান্টিয়ার কর্পসের মতো নাম সহ, ‘স্বেচ্ছাসেবক’ সংগঠনগুলি সাধারণত তাদের সদস্যদের সামরিক পোশাকের মতো অনানুষ্ঠানিক ইউনিফর্ম সরবরাহ করত, নিয়মিত অস্ত্র সহ বা ছাড়াই (সাধারণত লাঠি সহ) ড্রিল করত, তাদের শক্তি এবং শৃঙ্খলা প্রদর্শনের জন্য আধাসামরিক কুচকাওয়াজ করত এবং যুব প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করত।
এই আধাসামরিক স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে গুন্ডারাও ছিল। রাজনৈতিক দলগুলির প্রচারণার কথাগুলিকে বাস্তবে রূপান্তরিত করার এবং বাস্তবে কার্যকর করার জন্য একটি যন্ত্র হিসাবে এই গুন্ডাদের ব্যবহার করা হোত। কলকাতা গণহত্যায় স্বেচ্ছাসেবকদের ছদ্মবেসে এই গুন্ডারা সরাসরি জড়িত ছিল। বেঙ্গল প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভাপতি এবং গোপন বিপ্লবী সংগঠন যুগান্তরের একজন সিনিয়র নেতা সুরেন্দ্র মোহন ঘোষের দেওয়া একটি সাক্ষাৎকার অনুসারে, দাঙ্গা শুরু হওয়ার সময় কলকাতার প্রতিটি এলাকায় ইতিমধ্যেই দলের একদল সুশৃঙ্খল ‘স্বেচ্ছাসেবক’ ছিল। শহরটি ‘৩৬ বা ৩৭ ব্লকে’ বিভক্ত ছিল; এবং ঘোষ এই সমস্ত এলাকার গুন্ডাদের সাথে পরিচিত থাকার বিষয়ে গর্ব করেন। তিনি দাবি করেন যে, সেই গুন্ডারা জানত কীভাবে ছুরি বা বোমা ব্যবহার করতে হয়। হিন্দু মহাসভারও শহর জুড়ে মহাসভার স্বেচ্ছাসেবক এবং হিন্দুস্থান ন্যাশনাল গার্ড কমান্ডারদের একটি নেটওয়ার্ক ছিল।
দাঙ্গার প্রথম দিন (১৬ আগস্ট) ভোর থেকেই ‘স্বেচ্ছাসেবক’ সংগঠনগুলির উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছিল। উদাহরণস্বরূপ, মধ্য কলকাতার তালতলায়, সকাল ৭টার দিকে লাউডস্পিকার এবং ‘বিভিন্ন ধরণের যানবাহনে মুসলিম স্বেচ্ছাসেবকদের বিভিন্ন দল’ দেখা গিয়েছিল, এবং সম্ভবত এই দলটিই সকাল ৯.০০ টা থেকে দুপুরের মধ্যে সুরেন্দ্র নাথ বন্দ্যোপাধ্যায় রোডে হিন্দু যুবকদের সাথে সহিংস সংঘর্ষ এবং গয়নার দোকানে ব্যাপক লুটপাটে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। খাকি পোশাক পরে তারা লরি থেকে স্লোগান দিচ্ছিল। ইতিমধ্যে, কংগ্রেস তাদের ‘স্বেচ্ছাসেবকদের’ ‘প্রতিরোধের জন্য নিজেদের সংগঠিত’ করার নির্দেশ দেয়, তারফলে উভয় পক্ষে সংঘর্ষ বেঁধে যায়।
তবে ১৬/১৭ আগস্ট রাত থেকে, কলকাতার রাস্তা থেকে রাজনৈতিক দলগুলির মূল ‘স্বেচ্ছাসেবকরা’ কার্যত অদৃশ্য হয়ে যায়। বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অংশগ্রহণকারীরা, যার মধ্যে ছাত্ররাও ছিল, প্রথম দিনের সন্ধ্যায় রাস্তা থেকে সরে এসেছিল। তারপরে উভয় পক্ষের হত্যাকাণ্ড তাদের সম্প্রদায়ের গুন্ডাদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল।
প্রথমদিকে কোন রাজনৈতিক দলের নেতারা বুঝতেই পারেনি যে, তাদেরই হাতে তৈরি এই স্বেচ্ছাসেবক গুন্ডারা কি ভয়ানক পরিস্থিতির জন্ম দিতে যাচ্ছে। তবে, খুব বেশি সময় না যেতেই তারা বুঝতে পারল যে তারা একটা প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, কংগ্রেস নেতা সুরেন্দ্র মোহন ঘোষ ১৬ আগস্ট সকালে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে জনতার গতিবিধির উপর নজর রেখেছিলেন, কিন্তু দুপুরের দিকে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে মুহূর্তের মধ্যে পুরো কলকাতা জ্বলে উঠবে। ফলস্বরূপ, তিনি মুসলিম লীগের শীর্ষ নেতা খাজা নাজিমুদ্দিন এবং সোহরাওয়ার্দীকে ফোন করে আরও সহিংসতা রোধে তাদের সহযোগিতা কামনা করেন। সোহরাওয়ার্দী কংগ্রেস এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই) এর নেতাদের সাথে একটি ঝামেলাপূর্ণ স্থানে ছুটে যান; কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ক্ষুব্ধ জনতা তাদের দিকে পাথর ছুঁড়ে মারে, যার ফলে তিন নেতা দ্রুত পিছু হটতে বাধ্য হন। এই লজ্জাজনক কাহিনীটি আগস্টের সকালে হিংস্র জনতাকে শান্ত করার জন্য তিন দলের প্রতিনিধিদের দ্বিতীয় প্রচেষ্টার মাধ্যমে অব্যাহত থাকে, যে সময় কংগ্রেসের কিরণ শঙ্কর রায়, মুসলিম লীগের শামসুদ্দিন আহমেদ এবং সিপিআইয়ের মোহাম্মদ ইসমাইল মধ্য কলকাতার ইউরোপীয় আশ্রয় লেনের কাছে একটি জনতাকে ভাষণ দেন। তবে, তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা হয়েছিল এবং ঘটনাপ্রবাহে কোনও প্রভাব ফেলেনি।
বাংলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার মতে, ১৬ আগস্ট ময়দানে মুসলিম লীগ কর্তৃক আয়োজিত বিশাল সমাবেশে উপস্থিত ভিড়ে প্রচুর সংখ্যক মুসলিম গুন্ডা ছিল। সভা শেষ হওয়ার পর তারা সভা থেকে পালিয়ে যায় এবং উত্তর চৌরঙ্গী, ধর্মতলা, ওয়েলসলি এবং কর্পোরেশন স্ট্রিট এলাকায় হিন্দু দোকান এবং বাড়িঘর লুটপাট এবং পুড়িয়ে দেয়, যার মধ্যে চৌরঙ্গীতে কেসি বিশ্বাসের বন্দুকের দোকানও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এইভাবে সেদিন মধ্য কলকাতায় গুন্ডা সহিংসতার সূচনা হয়; এবং সেই সময় থেকে তাদের রাস্তায় মারামারি, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং হত্যা সহ সকল ধরণের সহিংসতায় জড়িত থাকতে দেখা যায়।
গুন্ডা হাবু
হাবিবুর রহমান, ওরফে হাবু, হাবু গুন্ডা, অথবা শেখ হাবু, সম্ভবত সেই সময় সক্রিয় বড় গুন্ডাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত ছিল। একজন ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার তার সম্বন্ধে বর্ণনা করেছেন – “প্রথমত, আমরা তাকে একটি সুসংগঠিত মিছিলের নেতাদের মধ্যে দেখতে পাই যারা সরাসরি ডাইরেক্ট ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে তে কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের মধ্য দিয়ে মিছিল করার চেষ্টা করেছিল: এই সময়ে [প্রায় ২.০০ টা] আমরা দেখতে পাই যে উত্তর দিক থেকে কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে শামবাজার ট্রাম ডিপোর কাছে একটি বড় সামরিক ধরণের লরির নেতৃত্বে একটি মুসলিম মিছিল আসছে, যার নেতৃত্বে ছিল একটি ব্যান্ড এবং মুসলিম পতাকা এবং লোকজন বোঝাই, সবাই স্লোগান দিচ্ছিল। তারা আমাদের কাছে এগিয়ে গেল যখন আমি [একজন ব্রিটিশ সিনিয়র সার্জেন্ট] লক্ষ্য করলাম যে লরিতে থাকা কিছু লোকের হাতে নগ্ন তরবারি এবং অন্যদের হাতে লাঠি ছিল। মিছিলে প্রায় ১,০০০ লোক ছিল, যার মধ্যে লরিতে থাকা লোকেরাও ছিল এবং হেঁটে যাচ্ছিল… তারা এগিয়ে গেল এবং যখন তারা টাউন স্কুলের কাছে পৌঁছাল তখন তারা খুব উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠল এবং আমি তাদের ফুটপাতে দৌড়াতে দেখলাম এবং তারপর আমি লক্ষ্য করলাম পাশের রাস্তা থেকে একটি হিন্দু জনতা বেরিয়ে আসছে এবং ইটপাটকেল ছোঁড়া হচ্ছে। লরিটি হঠাৎ উল্টে গেল এবং মুসলিম জনতা তার সাথে পিছু হটল এবং হিন্দুরাও… আমি লক্ষ্য করলাম যে লরি নম্বর CH584, লালবাগান বাস্তির এস. হাবু লরিটা চালাচ্ছিলেন। তিনি এই থানায় একজন খারাপ চরিত্রের লোক হিসেবে পরিচিত ছিলেন।”
যাইহোক, হাবিবুর রহমান কয়েক দিনের মধ্যেই রাস্তায় ভয়াবহ মৃত্যুবরণ করেন: সেদিন এতো মানুষ মারাগিয়েছিল যে, গ্রে স্ট্রিট-চিতপুর রোড অতিক্রম করার সময় অগ্রণী ট্যাঙ্কগুলিকে থামাতে হয় যাতে সৈন্যরা … কিছু মৃতদেহ একপাশে সরিয়ে দিতে পারে যাতে যানবাহন চলাচলের জন্য জায়গা থাকে…. পরের দিন রাস্তার মোড় থেকে দেড়শোরও বেশি মৃতদেহ সরিয়ে ফেলা হয় এবং এখানেই কলকাতার প্রধান গুন্ডাদের একজন হাবিবুর রহমান তার দুই হাতে ছুরি নিয়ে লড়াই করতে করতে মারা যায়। হাবিব চারদিক থেকে ঘেরার মধ্যে পড়েগিয়েছিলেন। একা হাতে তিনি হিন্দুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন এবং পরাজিত হওয়ার আগে বেশ কয়েকজন হিন্দুকে হত্যা করেছিলেন। হাবিবের মাথা তার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। এরপর মৃতদেহটি একটি গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল যার গায়ে লেখা ছিল ‘হাবিব পাকিস্তান পেয়েছে’।
হাবিবুর রহমান বস্তির ‘সন্ত্রাস’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। একই সাথে, তিনি ‘স্থানীয়দের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব’ ছিলেন। তিনি একজন সফল ছোট ব্যবসায়ী ছিলেন, কেবল লরিই নয়, একটি ট্যাক্সি এবং একটি ব্যক্তিগত গাড়িরও মালিক ছিলেন। তিনি অবৈধ পেট্রোল পাচারে জড়িত ছিলেন, তিনি একজন সক্রিয় মুসলিম লীগ কর্মীও ছিলেন। যদিও হাবিবুর রহমান একজন প্রচণ্ড মদ্যপানকারী এবং ঝগড়াটে ছিলেন, তিনি কেবল গুন্ডা ছিলেন না, তিনি সম্ভবত শিক্ষিত ছিলেন এবং ‘মুসলিম লীগ ডাইরেক্ট অ্যাকশন প্ল্যান’ শিরোনামের একটি লিফলেটের লেখক হিসেবে তাকে বিবেচনা করা হত।
হাবিবুর রহমানের মতো একজন প্রভাবশালী গুন্ডার, রাস্তার মাঝে এভাবে শোচনীয় মৃত্যুবরনের ঘটনা থেকে একটা বিষয় পরিস্কার হয়েযায় যে, দাঙ্গা করার জন্য মুসলমান গুন্ডাদের কোন সমবেত সংগঠিত প্রচেষ্টা বা পূর্ব পরিকল্পনা ছিল না।
সে তুলনায় হিন্দুরা ছিল অনেক বেশি সংগঠিত এবং তারা পূর্ব থেকেই সম্ভাব্য দাঙ্গার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। হিন্দুমহাসভার বিরামহীন প্রচারের ফলে একটা ভয় বা আতঙ্ক হিন্দু বাঙালির মনে বদ্ধমূল হয়েগিয়েছিল যে, পাকিস্থান তৈরি হলে হিন্দুদের অবস্থা অত্যন্ত করুন হবে, তাই যে কোন মূল্যে পাকিস্তানকে আটকাতে হবে।
গোপাল পাঁঠা
১৯৪৬ সালে, উত্তর কলকাতার কুখ্যাত গুন্ডা গোপাল পাঁঠার বয়স ছিল তেত্রিশ বছর। সবাই তাকে ডাকত ‘পাঁঠা’ বলে, যার অর্থ ছাগল, কারণ সে কলেজ স্ট্রিটে মাংসের দোকান চালাত। যদিও সে একদল পাড়ার দুষ্কৃতীর নেতা ছিল, গোপাল কিন্তু শহরের অপরাধী নিম্নশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিল না। তার ব্রাহ্মণ উচ্চবর্ণের পরিবার (তার বংশগত পদবী ছিল মুখার্জি) কংগ্রেস পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিল এবং ১৯৩০-এর দশকের সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। ১৬ আগস্ট ১৯৪৬ সালের সকালে, সে প্রতিদিনের মতো দোকানে গিয়েছিল, কিন্তু অশান্তির খবর পেয়ে আবার তার পাড়ায় ফিরে আসে।
বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গোপাল পাঁঠা সেদিনের ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন –
‘মুসলিম লীগ স্বেচ্ছাসেবকরা হাতে লাঠি নিয়ে মিছিল করছিল। বাবুবাজার মোড় থেকে হ্যারিসন রোড পর্যন্ত তাদের স্লোগান শোনা যাচ্ছিল—”লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান”। এরপর শুনলাম বেলিয়াঘাটায় দুইজন গোয়ালা (দুগ্ধ ব্যবসায়ী) খুন হয়েছে এবং বাবুবাজারে দাঙ্গা শুরু হয়েছে।’
‘দেশের অবস্থা তখন ভীষণ সংকটময়; দেশকে রক্ষা করতে হবে। আমরা যদি পাকিস্তানের অংশ হয়ে যাই তাহলে অত্যাচারিত হব… তাই আমি আমার সব ছেলেকে ডাকলাম এবং বললাম, এই সময় আমাদের পাল্টা আঘাত করতে হবে, আর নির্দয়তাকে নির্দয়তায় উত্তর দিতে হবে।’
তারা ছোট ছুরি, তরোয়াল, মাংস কাটার দা, লাঠি আর লোহার রড নিয়ে সজ্জিত হল, আর গোপালের কোমরে গুঁজে রাখা ছিল দুটি আমেরিকান পিস্তল। ১৯৪৫ সালে কলকাতায় অবস্থানরত মার্কিন সেনাদের কাছ থেকে সে এগুলো এবং কিছু গ্রেনেড কিনে নিয়েছিল। ‘দু’শ পঞ্চাশ টাকা দিলেই বা এক বোতল হুইস্কি কিনে দিলেই সৈন্যরা তোমাকে .45 ক্যালিবার পিস্তল আর একশো কার্তুজ দিয়ে দিত।’ দাঙ্গার খবর ছড়িয়ে পড়তেই তার দল আরও বড় হতে থাকে। জনবাজার এলাকার হিন্দুস্থানী গোয়ালারা, হাতে লাঠি নিয়ে, তার দলে যোগ দিল।
‘আমরা যারা আমাদের আক্রমণ করছিল তাদের সঙ্গে লড়াই করেছি… তাদের মেরেছি… যদি একখানা খুনের খবর শুনতাম, আমরা দশখানা খুন করতাম… অনুপাত হতে হবে একের বিপরীতে দশ, এটাই আমার ছেলেদের প্রতি আদেশ ছিল।’
গোপাল পাঁঠার মতোই, জুগলচন্দ্র ঘোষেরও কিছু লোক ছিল, এবং সেও শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্গত। সে বেলিয়াঘাটায় একটি কুস্তির আখড়া চালাত, আর তার অনুসারীরা বেলিয়াঘাটা ও মিয়াবাগান বস্তিতে পাল্টা আক্রমণ চালাত। জুগলচন্দ্র মহল্লার করাতকল, কারখানা এবং খাটাল থেকে টাকা তুলে হামলাকারীদের মধ্যে বিতরণ করত। ‘একটা খুন মানেই দশ টাকা আর একটা জখম মানেই পাঁচ টাকা।’ তার শহরের কিছু রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল—যেমন হিন্দু মহাসভার সম্পাদক বিধুভূষণ সরকার এবং কংগ্রেস-ঘনিষ্ঠ ট্রেড ইউনিয়ন নেতা (আইএনটিইউসি) সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।
দাঙ্গার প্রথম কয়েক দিনে মৃতদেহগুলো দেখে মুসলিম লীগের প্রতি ঘোষের রাগ আরও বাড়ে। ‘আমি চারটা ট্রাক দেখলাম, সবগুলো মৃতদেহে ভর্তি, অন্তত তিন ফুট উঁচু করে স্তূপ করা; যেন গুড়ের বস্তার মতো… সেই দৃশ্য আমার মনে প্রবল প্রভাব ফেলেছিল।’
সেসব দিনের সক্রিয় লোকদের সাক্ষাৎকার থেকে যে চিত্র বেরিয়ে আসে তা কলকাতার গলিঘুঁজিতে ও রাস্তায় তাণ্ডব চালানো জনতার চরিত্রও তুলে ধরে। শহরের উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের পাশাপাশি প্রায়ই এর মধ্যে থাকত এমন মানুষ যারা কলকাতার অধিবাসী ছিল না—গোয়ালা, দরোয়ান, ঘোড়ার গাড়িচালক, কয়লাঘাটের গাড়োয়ান, দর্জি, মাঝি আর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, এরা সবাই ‘আপ-কান্ট্রিম্যান’, জীবিকার জন্য শহরে আসা অভিবাসী।
বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে শহরের মাত্র তিন-দশমাংশ মানুষ কলকাতায় জন্মেছিল, আর শহরের শ্রমজীবী শ্রেণী বাইরের জেলা ও প্রদেশ থেকেই আসত। ১৯৩১ সালে, কলকাতায় বসবাসকারী কিন্তু ভারতের অন্য প্রদেশে জন্মগ্রহণকারী মানুষের হার ছিল ৩১.৭ শতাংশ, আর রাজ্যের অন্যান্য জেলায় জন্মগ্রহণকারীর হার ছিল মাত্র ০.৩ শতাংশ।
এই শ্রমিকদের বৃহৎ অংশই নিযুক্ত ছিল অদক্ষ শ্রমে—পাটকল, সুতাকল, রেলওয়ার্কশপ, কাঁচ-চিনির কারখানা ও চামড়া কারখানায়। আর এই লোকগুলোই হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই ১৯৪৬-এর আগে ও পরে কলকাতা দাঙ্গায় সবচেয়ে সক্রিয় ছিল।’
মুসলমান দাঙ্গাকারীদের মধ্যে বড় অংশ ছিল উত্তর ও মধ্য কলকাতার কসাই, খালাসি, রাজমিস্ত্রি ও ঘোড়ার গাড়িচালকরা। অনেক মুসলিম কলকারখানার শ্রমিকও মুসলিম লীগের ডাকা ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে-র সমাবেশে যোগ দিয়ে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে অংশ নেয়। তাদের হাতে ছিল ইট, বোমা, পেট্রলে ভেজানো জ্বলন্ত কাপড়, অ্যাসিডের বোতল, বোমা, সোডা-ওয়াটারের বোতল ও পেট্রল ভর্তি বোতল। বস্তিগুলো সহজ টার্গেটে পরিণত হয়েছিল।
হিন্দু দাঙ্গাকারীদের ক্ষেত্রেও সমকালীন বিবরণে আপ-কান্ট্রিম্যানদের বড় উপস্থিতির কথা উল্লেখ আছে। গোয়ালা, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, দরোয়ানদের পাশাপাশি স্থানীয় গুন্ডারাও অংশ নেয়।
উত্তর কলকাতার কসাই ও কলাবাগান বস্তি, বেলগাছিয়া, উল্টাডাঙা, রাজাবাজার, এন্টালি, নারকেলডাঙা, বকুলবাগান বস্তির বাসিন্দারা দলে দলে অস্ত্র নিয়ে একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
দাঙ্গায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাবুবাজার, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, চিৎপুর রোড, ক্যানিং স্ট্রিট, একবালপুর লেন, খিদিরপুর, গার্ডেনরিচ, পার্ক সার্কাস, ওয়াটগঞ্জ প্রভৃতি এলাকা।
হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেসের কিছু অংশ, ব্যবসায়ী ও ধনী বণিকরা দাঙ্গায় নেতৃত্ব দেয়। ১৮ আগস্ট আইএনএ দিবসে শহরে আসা বহু আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈনিকও দাঙ্গায় যুক্ত হয়। এমনকি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সংখ্যালঘুরাও এই অগ্নিকাণ্ডে অংশ নেয়।
সৈয়দ নাজিমুদ্দিন হাশিম, যিনি ১৯৪৬ সালের আগস্টে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ছিলেন, তিনি কলকাতার নিয়ন্ত্রণহীন দাঙ্গা ও হত্যাযজ্ঞের সাক্ষ্য দিয়েছেন।
‘প্রথম যে শিকারকে আমি দেখেছিলাম সে ছিল এক দরিদ্র ওড়িয়া মজুর… সে কিছুই জানত না কী ঘটছে… তার মাথায় ঝুড়ি ছিল এবং সে সাইড স্ট্রিটে ঢুকেছিল… মিছিল থেকে এক মুসলমান, লুঙ্গি পরে, আলাদা হয়ে গিয়ে তার মাথায় লোহার রড দিয়ে আঘাত করল। লোকটি পুরো বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল, আঘাতে তার কান ফেটে যায়…. সব খাবারের দোকান বন্ধ, নিউ মার্কেট বন্ধ, তিন দিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত দাঙ্গা আর লুটপাট চলল, যাতে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা পুরোপুরি অংশ নেয়; পিকআপ ট্রাক ব্যবহার করে এক মিউজিক ও রেডিও দোকান লুট করা হয়; ওয়েলিংটন স্কোয়ার আর চৌরঙ্গী রোডের ডিপার্টমেন্টাল স্টোর লুট হয়, সব মদের দোকানও লুট করা হয়।’
এটি আরেকটি সাক্ষাৎকারের বলা হয়েছে যে:
‘অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সার্জেন্ট আর পাঠান সৈন্যরা বিকাল ২:৩০-এ উল্লেখিত বাড়িগুলোতে (৪, জুগিপাড়া বাই লেন এবং ২৩২, ২৩৪এ এ এবং বি বিবেকানন্দ রোড) হামলা চালায়। শুধু পুরুষ সদস্যদেরই নয়, বাড়ির মহিলাদেরও আঘাত ও নির্যাতন করা হয়।’
কোলকাতা হত্যাযজ্ঞের জন্য সাধারন ভাবে মুসলিম লিগকেই দায়ী করা হয়। কিন্তু দাঙ্গা ঘটানোর জন্য মুসলিম লীগের দীর্ঘকালিন কোন প্রস্তুতি ছিল বলে কোন প্রমান নেই। মুসলমান দাঙ্গাকারীদের মধ্যে বেশিরভাগ ছিল পল্লি এলাকা থেকে শহরে আসা ভাসমান শ্রেণীর লোক। অপর দিকে হিন্দুমহাসভা ও তার সহযোগি দলগুলো দীর্ঘদিন ধরেই মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধে নামার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বহু সংখ্যক ভদ্রলোক হিন্দুকে দাঙ্গার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। দাঙ্গায় জড়িত হিন্দু জনতার গঠন সম্পর্কে আলোচনাকালে সুরঞ্জন দাশ লক্ষ করেন: দাঙ্গার অভিযোগে বাঙালি হিন্দু ছাত্র ও অন্যান্য পেশাজীবী বা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোক সক্রিয় ছিল। ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, প্রভাবশালী সওদাগর, শিল্পী, দোকানদার গ্রেফতার হয়। বিখ্যাত চক্ষু চিকিৎসক ড. জামাল মোহাম্মদকে হত্যাকারী জনতার মধ্যে একটা বড় অংশ ছিল ‘শিক্ষিত যুবক’। এটা বিস্ময়কর ছিল না যে, তাদের মধ্যে অনেকে পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে ইংরেজিতে কথা বলে। আরো বিস্ময়ের ব্যাপার যে, হত্যাযজ্ঞের পর অব্যাহতভাবে অসন্তোষের মধ্যে মুসলমান জনতার মাঝে বোমা নিক্ষেপের জন্য হিন্দুদের মধ্য থেকে গ্রেফতারকৃত একজন হিন্দু ছিল বর্ধমানের বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. মহেন্দ্রনাথ সরকার। তিনি স্বীকার করেন: ‘এখন আমি একজন কংগ্রেস নেতা। আগে আমি ছিলাম হিন্দু মহাসভার সদস্য। বাঙলা বিভাগের পক্ষে আমি এ আন্দোলনে যোগ দিয়েছি। ‘ হিন্দুদের পক্ষে যোগ দেয় ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত সৈনিক ও মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা। ছাত্র, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী এবং দোকানদার ও পাড়ার ভাড়াটে গুণ্ডা মার্কা ছেলেদের অভাবিত ঐক্যের ফলে কোলকাতার রাস্তায় সেদিন হিন্দু জনতার রক্তক্ষয়ী বিজয় হয়। এই হিন্দু একতা একদিনে তৈরি হয়নি, দীর্ঘদিন ধরে এর প্রস্তুতি চলছিল।
“ত্রিশ দশকের শেষে এবং চল্লিশ দশকের প্রথম দিকে কোলকাতা ও মফস্বল শহরগুলোতে হিন্দু স্বেচ্ছাসেবক গ্রুপের সংগঠন প্রতিষ্ঠার আধিক্য দেখা যায় গ্রুপের বিঘোষিত নীতি ছিল হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করা; কিন্তু তারা ভদ্রলোক যুবকদেরকে দৈহিক যোগ্যতা অর্জন করতে ও আধা-সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে উৎসাহ দিতে অধিকতর শক্তি ব্যয় করত। সম্ভবত এসব সংগঠনের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে সুসংগঠিত সংগঠন ছিল ভারত সেবাশ্রম সংঘ। এটা ছিল হিন্দু মহাসভার স্বেচ্ছাসেবক শাখা। প্রকাশ্যে সমাজ সেবা সংগঠন হলেও শুরু থেকে এই সংঘ সামরিক কৌশল গ্রহণ করে এবং হিন্দুদের আত্মরক্ষার কৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ গ্রহণের আহ্বান জানায়।
১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত সংঘের এক সভায় ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী সভাপতিত্ব করেন। এ সভায় ২,৬০০ লোক যোগদান করে বলে জানা যায়। সভায় বক্তারা সম্প্রদায়গত রোয়েদাদের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলেন, এর উদ্দেশ্য বাঙালি হিন্দুদের প্রতিহত করা। তাঁরা বলেন যে, সাবেক দণ্ডিত অপরাধী পুলিন দাস ও সতীন সেনের সাহায্য নিয়ে তাদের আখড়া তৈরি করে দৈহিক গঠনের প্রতি মনোযোগী হওয়া উচিত যাতে হিন্দুরা আক্রান্ত হলে যেন এক হাজার লাঠি উত্তোলিত হয়।
বাঙলায় লেখা পোস্টার ছাপানো হয় এর মধ্যে একটা পোস্টারের শিরোনাম ছিল ‘এখনই অহিংসার চেতনা ত্যাগ করো, প্রয়োজন হল পৌরুষ’, দু’মাস পর অনুষ্ঠিত সংঘের অন্য এক সভার প্যান্ডেলে প্রদর্শিত প্লাকার্ডে বাঙলায় লেখা ছিল: ‘হিন্দুরা জাগ্রত হও এবং অসুরদের হত্যার শপথ গ্রহণ করো।’ এর পরের বছর শিবের ধর্মীয় মূর্তিকে ব্যবহার করে একই মূলভাবকে প্রকাশ করা হয়।
৭ তারিখে (এপ্রিল, ১৯৪০) সেবাশ্রম সংঘের উদ্যোগে মহেশ্বরী ভবনে একটা হিন্দু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। হিন্দুদের সামরিক মানস গড়ে তোলার জন্য সেখানে বক্তৃতা করা হয়। ত্রিশূলসহ শিবের একটা বড় চিত্র প্রদর্শিত হয় স্বামী বিজনানন্দ বলেন যে, অসুরকে ধ্বংস করার জন্য হিন্দু দেব-দেবীরা সব সময় বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত থাকতেন। স্বামী আদিত্যনন্দ … মন্তব্য করেন যে, তিনি হিন্দুদের সেবা করার জন্য একটা লাঠি নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন যে, হিন্দুর শত্রুদের মুণ্ডচ্ছেদ করতে হবে। ত্রিশূলসহ শিবের চিত্রের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন যে, তাঁর অনুসারীদের অস্ত্র, কমপক্ষে লাঠি হাতে এগিয়ে আসতে হবে স্বামী প্রণবানন্দ পাঁচ লাখ লোকের একটা প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তুলতে চান। তিনি মাড়োয়ারিদের কাছে অর্থ সাহায্যের আবেদন জানান। হরনাম দাস প্রত্যেক হিন্দুকে সৈনিক হওয়ার আহ্বান জানান। পাঁচ লাখ হিন্দুর একটা প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তোলার সংঘের প্রস্তাব গৃহীত হয়। এতে সন্তুষ্টির সাথে উল্লেখ করা হয় যে, ইতিমধ্যে বারো হাজার লোককে সংগ্রহ করা হয়েছে।
চল্লিশ দশকের প্রথম দিকে কোলকাতার হিন্দু স্বেচ্ছাসেবক গ্রুপের সংখ্যা বেশ বৃদ্ধি পায়। এর মধ্যে মহাসভার অপর এক ‘সক্রিয়’ শাখা হিন্দু শক্তি সংঘ ছিল বেশ বড় ও সুগঠিত। এর পাঁচশ’র বেশি সদস্য শহরের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন শাখার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল এবং এদের আর্থিক অবস্থা ছিল ভালো। বড় বড় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে প্রায়শই বিপুল আর্থিক সাহায্য দেওয়া হত। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, ভারত সেবাশ্রম সংঘ মাড়োয়ারিদের সাহায্য পেত। সুসঙ্গ রাজ পরিবারের বাবু পরিমল সিংহ ছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের একজন অনুগত সমর্থক। বলা হয় যে, বাঙলায় এ সংঘের সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় এক লাখ।
চল্লিশ দশকের সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং হিন্দু মহাসভা ও হিন্দুত্ববাদী কংগ্রেসের রাজনীতিতে কোলকাতার হিন্দু ভদ্রলোক যুবক শ্রেণীর ব্যাপক অংশকে সংগঠিত করতে এ ধরনের সংগঠন খুবই কার্যকর ছিল। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ তার তালিকাভুক্ত যুবকদের ‘শারীরিক প্রশিক্ষণ’ দিত, তার মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত ছিল। যুদ্ধের পর সামরিক কাজ থেকে অব্যাহতি পাওয়া সৈনিক ও সামরিক কর্মচারীদেরকে হিন্দু সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলোর জন্য আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগহ করতে প্রলুব্ধ করা হয়। যুদ্ধের পর থেকে সামরিক বাহিনী থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত সৈনিকদের মাঝে মহাসভা খুবই সক্রিয় ছিল; তারা সৈনিকদের এবং ‘অব্যাহতিপ্রাপ্ত ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির লোকদের মহাসভার পতাকাতলে’ সংগঠিত করার চেষ্টা করে এবং সৈন্যবাহিনীর সাবেক কর্মচারীদের নিয়ে হিন্দু যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে’।
শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর কাছে লিখিত পানাগড়ের একজন সাবেক হিন্দু সৈন্য অফিসার আবেগতাড়িত এক পত্রে ঘোষণা করেন: হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলায় আমাদের বিপজ্জনক শত্রু মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য আমরা বর্ধমান জেলার সৈন্যবাহিনীর সাবেক হিন্দু কর্মকর্তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি … আমরা প্রস্তুত আছি, আপনার নির্দেশ আমরা অনুসরণ করব। আমরা শপথ নিয়েছি এবং আমাদের আন্তরিক ইচ্ছা পূরণে আমরা বিরত হব না। আমরা অস্ত্রসজ্জিত এবং যুদ্ধ কৌশল সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত … আমরা মনে করি যে, প্রতিশোধ গ্রহণের এই পদ্ধতিতে প্রদেশের বর্বর মুসলমানদের থামিয়ে দিতে পারব এবং এ থেকে তাদের বর্ণসংকর (halfcast) কুখ্যাত নেতা সোহরাওয়ার্দী ও নাজিমুদ্দিন প্রতিশোধ গ্রহণে হিন্দুদের সাহস সম্পর্কে অনুধাবন করতে পারবে।
মুসলমানদের এইভাবে প্রাণপণে প্রতিহত করার পটভূমিতে ১৯৪৫-৪৬ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার পর তাই বিস্ময়ের কিছু নেই যে, কয়েক মাস পর হিন্দু স্বেচ্ছাসেবীরা কোলকাতায় তাদের শক্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত ছিল।
বি. আর. মুনজে মহাসভার নির্বাচনী প্রচারণায় সর্ব প্রথম কামান দাগেন এই ঘোষণা করে: হিন্দু মহাসভা স্বাধীনতা চায়, কিন্তু তারা বিশ্বাস করে না যে অহিংস পথে তা অর্জন করা যাবে। এ জন্য তা পাশ্চাত্যের অতি আধুনিক বৈজ্ঞানিক ধারায় আক্রমণকে সংঘটিত করতে চায় … গৃহযুদ্ধের হুমকির (মুসলিম লীগের) মোকাবেলায় কংগ্রেস যদি মহাসভার শ্লোগান ‘অশ্বচালনা ও রাইফেল শুটিং-এ যুবকদের শিক্ষা দাও’ গ্রহণ করে তাহলে তা হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
বাঙলায় যখন গৃহযুদ্ধ সত্যি সত্যি আসন্ন হয়ে দাঁড়াল, তখন মহাসভা স্বেচ্ছাসেবীরা প্রস্তুত ছিল বাঁশের লাঠি, ছোরা ও দেশীয় পিস্তল নিয়ে নেতাদের পরামর্শ মতো কাজ করতে, তারা বাহিনীর মতো যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে ব্যগ্র ছিল।”
প্রতিবেশী সংহতি
কলকাতায় যখন অভূতপূর্ব দাঙ্গা শুরু হয়, তখন কিছু জায়গায় স্থানীয় বাসিন্দারা অপ্রত্যাশিত ‘প্রতিরক্ষা দল’ সংগঠিত করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, নারকেলডাঙ্গা বস্তিতে বসবাসকারী রেলকর্মীরা ‘বহিরাগতদের পাড়ায় প্রবেশ রোধ করার জন্য একটি ঐক্যবদ্ধ হিন্দু স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী’ গঠন করেছিলেন। অন্যান্য জায়গায় স্থানীয় লোকেরা তাদের ‘পাড়া’ রক্ষার জন্য ব্যারিকেড তৈরি করেছিলেন। পার্ক সার্কাস এলাকায় ব্যারিকেডিং বিশেষভাবে লক্ষণীয় ছিল, যেখানে মুসলিম বাসিন্দারা ‘লোহার গেট এবং ঠেলা গাড়ি দিয়ে বেশ কিছু গলির চারপাশে ব্যারিকেডিং করেছিল। মিশ্র জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত পার্ক সার্কাসের পশ্চিমে রিপন স্ট্রিটে, ১৭ আগস্ট সন্ধ্যায় মুসলিমরা ‘শিখদের আসন্ন আক্রমণের খবর পেয়ে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের সহায়তায় ব্যারিকেড’ তৈরি করে।
উত্তর কলকাতায়, যেখানে সংখ্যালঘু মুসলিমরা বিচ্ছিন্ন ছোট ছোট পকেটে বাস করত, সেখানে হিন্দু অনুপ্রবেশকারীদের আক্রমণ থেকে তাদের রক্ষা করার জন্য মাঝে মাঝে পাড়ার সংহতি কার্যকর সুরক্ষা হিসেবে কাজ করেছিল। উদাহরণস্বরূপ, মসজিদবাড়ি স্ট্রিটে, ৬টি পাকা (ইট দিয়ে তৈরি) ভবন এবং কুঁড়েঘর নিয়ে একটি ছোট বাসস্থান ছিল, যেখানে প্রায় ১০০ জন মুসলিম বাস করত। ১৬ আগস্ট যখন একটি হিন্দু জনতা এই পাড়ায় আক্রমণ করার চেষ্টা করেছিল, তখন এর হিন্দু বাসিন্দারা দাঁড়িয়ে ছিল। হিন্দু বহিরাগতরা মুসলিমদের আক্রমণ করতে পারেনি ‘কারণ এলাকার সমস্ত হিন্দু তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছিল’। ‘একজন মুসলিমকেও হত্যা করা হয়নি, কারণ হিন্দুরা তাদের রক্ষা করেছিল’। পরের দিন আরেকটি প্রচেষ্টার পর, পুলিশের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের ফলে মুসলিমদের উদ্ধার করা হয় এবং তাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়।
১৬ এবং ১৭ আগস্ট উত্তর কলকাতার বিডন স্ট্রিটের রাম চাঁদ ঘোষ লেনের ধুলিপাড়া এলাকায় ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা আমাদের একটি আভাস দেয় যে কীভাবে একটি পাড়ার সম্প্রদায় প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে কাজ করতে পারে। এই পাড়ায় একটি ছোট মুসলিম বসতি ছিল। ১৬ আগস্ট সন্ধ্যা ৬.৫০ মিনিটে বুড়োতোলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ধুলিপাড়ায় বসবাসকারী একজন হিন্দু আইনজীবী সত্যেন্দ্রনাথ বোসের কাছ থেকে একটি চিঠি পান, যেখানে লেখা ছিল: ধুলিপাড়া এলাকাটি অত্যন্ত বিপদের মধ্যে রয়েছে। আমাদের এলাকার মুসলিম বাসিন্দারা, যারা বেশ নির্দোষ এবং কোন ঝামেলায় জড়ায় না, তাদের উপর অযথা আক্রমণ করা হচ্ছে সোনাগাছি ও রামবাগান এলাকার দালাল, প্রাক্তন আসামি এবং দুর্বৃত্তদের দ্বারা। এই উগ্রপন্থীরা এখন নতুন বাজার এলাকার লোকদের দ্বারা উত্তেজিত। প্রায় ২০০ জন লোকের অবস্থা খুবই খারাপ। আমাদের হিন্দু প্রতিবেশীদের মধ্যে যারাই তাদের সাহায্য করতে যায় তাদের উপরও আক্রমণ করা হচ্ছে। কখনও কখনও এই দুষ্টুরা শত শত লোকের দলে দলে আক্রমণ করে। তাদের একমাত্র লক্ষ্য এলাকার লোকদের লুট করা, অন্য কিছু নয়। যদি এখানে পুলিশ মোতায়েন করা হয় এবং টহল দেয় তবে বেশিরভাগ পাড়ার মানুষ পুলিশকে সাহায্য করবে। এটি খুবই জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ এবং আমি আশা করি আপনি অবিলম্বে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন। ধুলিপাড়া এলাকার জনগণের পক্ষ থেকে এবং বিশেষ করে এলাকার নিরীহ মুসলিমদের জন্য আমি এই আবেদন জানাচ্ছি, যারা ১৫ নম্বর রাম চাঁদ ঘোষ লেনের মসজিদে অস্থায়ীভাবে আশ্রয় নিয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ধুলিপাড়ায় ছুটে যান এবং স্থানীয় জনগণের সাথে ‘প্রায় আধ ঘন্টা ধরে এক ধরণের সম্মেলন’ করেন। এর ফলে হিন্দু ও মুসলিম বাসিন্দারা একটি চুক্তিতে উপনীত হন, যেখানে হিন্দুরা প্রতিশ্রুতি দেন যে তারা তাদের জীবনের বিনিময়ে তাদের মুসলিম প্রতিবেশীদের রক্ষা করবেন, অন্যদিকে মুসলমানরা বিশ্বাস করেন যে হিন্দুরা তাদের কথা রাখবেন। এই ‘সম্মেলনের’ পরে মুসলমানরা যে মসজিদে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেখানে কমপক্ষে তিনবার আক্রমণ করা হয়েছিল। রাতে দ্বিতীয় আক্রমণের সময়, ‘ঐ এলাকার দুই বা তিনজন হিন্দু মুসলিম রক্ষকদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন এবং তাদের মধ্যে কয়েকজন আহত হন’। তবে, তৃতীয় আক্রমণের সময়, ধুলিপাড়ায় সংহতি ভেঙে পড়ে, কারণ ‘১৭ তারিখ সকালে যখন তৃতীয় আক্রমণ শুরু হয়, তখন স্থানীয় হিন্দুদের অনেকেই এই মুসলিমদের বাড়িঘর লুটপাট এবং মুসলিমদের হত্যা করতে ওই দুর্বৃত্তদের সাথে যোগ দিতে দেখা যায়’। একই দিন সন্ধ্যায় ধুলিপাড়ায় পৌঁছানোর পর, দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার মসজিদে ১২ থেকে ১৩টি মৃতদেহ দেখতে পান।
উপসংহার
১৯৪৬ সালের আগষ্ট গণহত্যার দায়, ব্রিটিশ রাজ, মুসলিম লীগ, কংগ্রেস, হিন্দুমহাসভা – সবার উপরেই বর্তায়।
১৯৪৬ সালের আগস্টে, বাংলা সরকারের ক্ষমতাকেন্দ্র কার্যত দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে, একটির নেতৃত্বে ছিলেন বাংলার প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যটি ব্রিটিশ গভর্নর, যারা একের পর এক টানাপোড়েনে লিপ্ত ছিল। ১৬/১৭ আগস্টের গুরুত্বপূর্ণ রাতে, যখন শহরজুড়ে খুন ও তাণ্ডব চলছিল, সামরিক ‘টহল’-এর মতো হালকা অর্ধ-পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্তে রায়ে মারাত্মক ভুল হয়েছিল। কেন এত বিলম্ব এবং দোদুল্যমানতা? এখানে আকর্ষণীয় তথ্যটি উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে বাংলার গভর্নর এফজে বারোজ লন্ডনে তার টেলিগ্রামে কলকাতায় গুরুতর দাঙ্গার প্রাদুর্ভাবের কথা জানিয়ে এই আশ্বাস দিয়েছিলেন যে ‘এখন পর্যন্ত ঘটে যাওয়া অশান্তি স্পষ্টতই সাম্প্রদায়িক এবং কোনওভাবেই ব্রিটিশ-বিরোধী, বা সরকার-বিরোধী নয়’।
আসলে ব্রিটিশ-বিরোধী নাগরিক আন্দোলনের বিষয়ে ব্রিটিশ রাজ অত্যন্ত সতর্ক ছিল, মাত্র গত ফেব্রুয়ারি মাসে লাল কেল্লায় বন্দি আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈনদের মুক্তির দাবিতে যে অশান্তি হয়, তখন ব্রিটিশ পুলিশের গুলিতে ৩০০০-৪০০০ মানুষ মারা গিয়েছিল, তাই ভারত ছেড়ে যাওয়ার আগে ব্রিটিশ রাজ আর নতুন করে কোন ঝামেলায় জড়াতে চাইছিলনা। প্রকৃতপক্ষে, পূর্ব কমান্ডের সেনা জেনারেলরা আশঙ্কা করেছিলেন যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ব্রিটিশ-বিরোধী বিদ্রোহে রূপান্তরিত হতে পারে, যেমন কলকাতা এলাকার দায়িত্বে থাকা ব্রিগেডিয়ার সিক্সস্মিথ অস্থিরতার কয়েক বছর পরে লেখা তার নোটে প্রকাশ করেছিলেন: ‘যদিও প্রথম ঘটনাটি [১৬ আগস্ট] সাম্প্রদায়িক হতে পারে, আমি ভেবেছিলাম, এবং আমার ধারণা ছিল যে ভারতীয় বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ ব্রিটিশ-বিরোধী মনোভাবকে আরও তীব্র করে তুলবে এবং ব্রিটিশদের জন্য আরও খারাপ পরিস্থিতি তৈরি করবে
মুসলিম লীগ সরকারে ক্ষমতায় ছিল, তারাই ডাইরেক্ট অ্যকসন ডের ডাক দিয়েছিল, প্রাথমিক অশান্তি তারাই শুরু করেছিল, কিন্তু তার সম্ভাব্য পরিনতি সম্পর্কে তার সম্পুর্ন অন্ধকারে ছিল। এটা ছিল নিঃসন্দেহে মুসলিম লীগ নেতা মন্ত্রীদের চুড়ান্ত অপদার্থতার পরিচয়।
হিন্দুমহাসভা অনেক আগে থেকেই এই দাঙ্গার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। বস্তুত তারাই ছিল এই দাঙ্গার মূল কারণ। কয়েক বছর ধরে শহরে, শহরতলিতে, গ্রামে, গজ্ঞে তারা মুসলমান সম্রদায়ের বিরুদ্ধে এবং বাংলা ভাগের পক্ষে প্রচার প্ররোচনা চালাচ্ছিল। এবং ১৯৪৬ এর আগষ্ঠে কলকাতা গণহত্যা ১৯৭৪এর আগষ্ঠে তাদের বহু কাঙ্খিত বাংলা ভাগে সহায়তা করেছিল।
তথ্যসূত্রঃ
The Role of Colonial Administration, ‘Riot Systems’ and Local Networks during the Calcutta Disturbances of August 1946 By Nariaki Nakazato
A City Feeding on Itself: Riots, Testimonies and Literatures of the 1940s in Calcutta By Debjani Sengupta
Bengal Divided: Hindu Communalism and Partition, 1932-1947, JOYA CHATTERJI,
